অটিজম মোকাবিলায় বাংলাদেশ
- প্রকাশিত সময় ০১:৪২:৪৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ মার্চ ২০২০
- / 126
অটিস্টিক শিশুরা সমাজের বোঝা নয়। একজন সুস্থ সবল শিশুর মতো তাদেরও বেড়ে ওঠার সমান অধিকার রয়েছে।
দেশের ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে অটিজম আজ আন্তর্জাতিক সমস্যা। এ সমস্যা দূরীকরণে পারিবারিক পর্যায়ে থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মহলের বিশেষ মনোযোগই মূল হাতিয়ার। তাই অটিজমে আক্রান্ত শিশুকে কোনো রকম হেলা না করে তার বিকাশের সম্ভাবনাটুকু যাচাই করে তাকে সহযোগিতা করতে হবে। এ জন্য অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অটিজম আক্রান্তদের সহায়তায় আরো বড়ো পরিসরে কাজ করার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তাত্ত্বিকভাবে আমরা যা বুঝতে সক্ষম, সবক্ষেত্রেই এর চর্চা হয় না। তাই শুরুতেই অটিজম আক্রান্তদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি ভবিষ্যতে চাকরির উপযোগী করে গড়ে তুলতে শিক্ষাক্ষেত্রেও সহযোগিতা করতে হবে। অটিজম আক্রান্তদের কোনো ধরনের কষ্ট দেওয়া বা তাদের উপেক্ষা করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল।
অটিজম আন্দোলনে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের জন্মনিবন্ধন, অটিস্টিক শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে পারিবারিক ভূমিকা, জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি বিষয়ে বাংলাদেশ রোল মডেল হিসেবে বিশ্ববাসীর স্বীকৃতি পেয়েছে এবং পাচ্ছে।
অটিজম মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতা, যা শিশুর জন্মের তিন বছরের মধ্যে প্রকাশ পেয়ে থাকে। বাংলাদেশ ও ভারতে প্রতি ৫০০ জনে একজন এবং আমেরিকাতে প্রতি ১০,০০০ জনে ৪.৫ জন শিশু অটিস্টিক। বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশুদের মানসিক বিকাশে সহায়ক প্রশিক্ষণ প্রদানে বিশেষ মডিউল তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটও গড়ে তোলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার তনয়া সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অটিজম মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দক্ষ-অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষিতদের তত্ত্বাবধান, বিশেষ শিক্ষা কর্মসূচির ব্যবস্থা, প্রত্যেক শিশুর বিশেষ চাহিদা পূরণ,বিকলাঙ্গ শিশুদের আর্থিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থার আওতায় আনা এবং অটিস্টিক শিশুদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
চিকিৎসকদের মতে, অটিজম কোনো মানসিক রোগ নয়, মস্তিষ্কের একটি বিকাশ গত সমস্যা। যেটা একটি শিশুর তিন বছরের মধ্যেই প্রকাশ পায়। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের অটিস্টিক হবার সম্ভাবনা বেশি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অটিজম আক্রান্ত শিশুরা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বয়সের তুলনায় পিছিয়ে থাকে। একই ধরনের আচার-আচরণ তারা বারবার করে থাকে।
ঢাকার মিরপুরে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাসে অটিজম রিসোর্স সেন্টার ও একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করে বিনামূল্যে বিভিন্ন সেবা দেওয়া হচ্ছে। এখানে অটিস্টিকসহ প্রতিবন্ধী মানুষদের এক সঙ্গে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। ঢাকা সেনানিবাসে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘প্রয়াস’ নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় এর শাখা করার কাজ চলছে। পাশাপাশি প্রতিটি সেনানিবাসে শাখা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অটিজমে আক্রান্তদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিনামূল্যে থেরাপিউটিক, কাউন্সেলিং ও অন্যান্য সেবা এবং সহায়ক উপকরণ দেওয়া হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলা ও ৩৯ টি উপজেলায় মোট ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার চালু করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে অটিজম কর্নার চালু করা হয়েছে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালসহ ১৫টি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্থাপন করে অটিজম ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল সমস্যাজনিত শিশুদের চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে অটিজম আক্রান্তদের শনাক্ত করে তাদের কাউন্সিলিং ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট ফর পেডিয়াট্রিক নিউরো-ডিজ অর্ডার এন্ড অটিজম’-এর মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। অটিস্টিক শিশুদের প্রাথমিক পরিচর্যাকারী হিসেবে মায়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া অটিজম ও স্নায়ু-বিকাশজনিত সমস্যা প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করার জন্য বিশেষজ্ঞ গ্রুপের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের উপযোগী করে স্ক্রিনিং টুলস প্রণয়ন কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অটিস্টিক শিশুদের আঁকা ছবি দিয়ে ২০০৯ সাল থেকে ‘প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দিবসের কার্ড’ তৈরি হয়।
অটিজম আক্রান্তদের স্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষায় নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টি বোর্ড গঠন ও সেখানে তিন হাজার একশ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকার পরিবর্তন হলেও সেবামূলক এই কার্যক্রম যেন অব্যাহত থাকে সেজন্য ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এ সমস্যা মোকাবিলায় বেসরকারিভাবেও নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বেসরকারি পর্যায়ে অনেক আগে থেকেই অটিজম বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে ঢাকায় অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ঢাকার বাইরেও রয়েছে কিছু প্রতিষ্ঠান।
২০০১ সালে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষায় প্রথম আইন প্রণয়ন ও ‘আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স’ গঠন করে। এ ছাড়া অটিজমসহ এনডিডি (নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজ অর্ডার) আক্রান্তদের চিকিৎসাসহ যাবতীয় অধিকারের সুরক্ষা আইনের আওতায় আনতে ২০১৩ সালে ‘ডিজএবিলিটি ওয়েল ফেয়ার অ্যাক্ট’ ও ‘দ্য ন্যাশনাল নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজ অর্ডার প্রটেকশন ট্রাস্ট অ্যাক্ট’ করা হয়। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অটিজম সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১১ সালের জুলাই মাসে ‘সাউথ এশিয়ান অটিজম নেটওয়ার্ক’ গঠিত হয়, যার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দৈহিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের সমাজের অংশ বলে গণ্য করার জোর প্রচার চলছে। অটিজমের বিষয়ে গুরুত্বআরোপ করে ২০০৮ সালে ২ এপ্রিলকে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ ঘোষণা করা হয়। পরের বছর থেকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
এদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা আছে। সেটাই বিকশিত করে দেয়ার সুযোগ করে দিতে হবে, যেন মেধা বিকাশের মাধ্যমে তারাও সমাজকে কিছু উপহার দিতে পারে। একটি রাষ্ট্র তখনই কল্যাণকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়, যখন প্রত্যেক নাগরিকের জন্য যথাযথ সুযোগ-সুবিধা বজায় থাকে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে যুক্ত। উন্নয়নের এই দীর্ঘপথ পাড়ি-দিতে দেশের সবার অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অটিজম শিশু এবং প্রতিবন্ধীরা সঠিক পরিবেশে বেড়ে উঠছে। এক সময় তারা দেশের উন্নয়নে তাপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে যে মানব ভালোবাসা এবং মুক্তির বারতা ছিল, তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশের অটিজম শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তার সুযোগ্য কন্যা ও নাতনি।
ড. শিল্পী ভদ্র