কুড়িগ্রামঃ সুলতানা পারভীন ভাইরাস ও টিকা
- প্রকাশিত সময় ০৩:১০:৫১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ মার্চ ২০২০
- / 172
কুড়িগ্রামের সদ্য প্রত্যাহৃত ডিসি সুলতানা কামালের নাম এতদিন বাংলাদেশে অপরিচিত থাকলেও দু তিন সপ্তাহ যাবত তিনি সারা দেশে পরিচিত হতে পেরেছেন-পেরেছে বিখ্যাত হতেও।
জেলা প্রশাসকের পদে উন্নীত হয়ে এর চাইতে বেশী পরিচিতি অর্জন তাঁর মত করে না করলে স্বল্প সময়ে যে তা সম্ভব না সেটাও তিনি প্রমাণ করে ছাড়লেন। ইতিহাসে, একজন ডিসি হিসাবে এর চাইতে বেশী হয়তো তাঁর প্রত্যাশায়ও ছিল না। শুধু কামনা করবো সুলতানা পারভীন ভাইরাসটি যেন বাদবাকী ৬৩ জেলার ডিসিকে আক্রমন না করে বসে।
এর আগে এই বিষয়ে একটি নিবন্ধে আমি ভাইরাসটির নাম দিয়েছিলাম ডিসি ভাইরাস। দু:খিত, ঝোঁকের মাথায় অমন নামকরণ করেছিলাম কারণ তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক, আমি হয়তো দেশের ৬৪টি জেলার জেলা প্রশাসকই এমন ভাইরাসে আক্রান্ত। তেমন ভাবনা আদৌ সত্য নয়। কারণ জানা মতে বাদ-বাকী ডিসিদের মধ্যে এমন রোগে সংক্রমণ ঘটেনি।
সুলতানা পারভীনকে এবং তাঁর সাথে সহযোগি হিসেবে যাঁরা বিপুল সার্ভিস দিয়ে কুড়িগ্রামের বাংলা ট্রিবিউন সংবাদদাতা আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে মধ্য রাতে তাঁর শোবার ঘরের দরজা ভেঙ্গে পেটাতে পেটাতে তাঁকে তুলে নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে রাতের গভীর হিংশ্র দানবের মত আক্রমণ, কাপড় খুলে পাশবিক নির্যাতন, ঘড় থেকে মাদকদ্রব্য উদ্ধারের কাহিনী সংক্রান্ত অভিযোগ আনায়ন ও গভীর রাতে মোবাইল কোর্টে বিচারের প্রহসন করে জেলে পাঠানো এবং তার পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানার শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে সভ্য আচরণ ও ন্যায় বিচারের যে অভূতপূর্ব নিদর্শন রেখেছিলেন সুলতানা পারভীনের সাথে সেই চারজন অভিযুক্ত ম্যাজেষ্ট্রেটকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যাস্ত করা হয়েছে। আর বলা হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হবে।
এই খবর জানার পর পূর্ববর্ণিত নিবন্ধে আমার …. প্রমান করে তাঁদের বিরুদ্ধে কতিপয় সুবিনির্দৃষ্ট অভিযোগে ফৌজদারী মামলা দায়ের করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রমান করেছিলাম। সেটাই হতে পারে ঐ ভাইরাসের প্রতিরোধক টিকা এমন ইঙ্গিত ও দিয়েছিলাম।
গত ২০.০৩.২০২০ তারিখে দৈনিক সমকালের শেষ পৃষ্টায় প্রকাশিত “কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসিসহ ৪০ জনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ রিগ্যানে” খবরটিতে বলা হয়েছে-
“মধ্যরাতে বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে মামলায় জড়ানোর ঘটনায় কুড়িগ্রামের সদস্য প্রত্যাহৃত জেলা প্রশাসক মোছাঃ সুলতানা পারভীন ও তিন ম্যাজিষ্ট্রেটসহ ৪০ জনের বিরুদ্ধে সদর থানায় (কুড়িগ্রামের) লিখিত অভিযোগ দায়ে করেছেন সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যান। তাঁর পক্ষে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে এজাহারটি দাখিল করেন অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নূরুজ্জামান বাবু। রিগ্যান বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি।
এজাহারে তিন ম্যাজিষ্ট্রেট কুড়িগ্রামের সদ্য সাবেক আর ডিসি নাজিম উদ্দিন, সিনিয়র সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট এম এম রাহাতুল ইসলামের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
এজাহার দায়েরের সময় কুড়িগ্রামের প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান বিপ্লব, জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহবায়ক শ্যামল ভৌমিক, জেলা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ দুলাল ঘোষ, জেলা টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ আলমগীরসহ বিভিন্ন প্রিন্ট ও মিডিয়ার সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
কুড়িগ্রাম সদর থানার ওসি মোঃ মাহফুজার রহমান এজাহারটি গ্রহণ করেন। এ সময় পরিদর্শক (তদন্ত) রাজু সরকার উপস্থিত ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরিফুল ইসলাম রিগ্যান জানান, ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযোগের নামে তার বাড়ীর দরজা ভেঙ্গে তাকে ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাকে ক্রসফায়ারে হত্যার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এছাড়া তাকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্যাতন চালানো হয়েছে। চোখ বাঁধা অবস্থায় ৪টি কাগজে তার স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। এরপর মাদকের মিথ্যা মামলায় এক বছর কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে রাতেই কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
তাঁর প্রতি এই অন্যায়ের বিচার পাওয়ার জন্যেই এজাহারটি স্বাক্ষর করে থানায় পাঠিয়েছেন। রিগ্যান আরও জানান, নির্যাতনের কারণে তাঁর ডান হাত কাজ করছে না। এ জন্য বাঁ হাত দিয়ে এজাহারে স্বাক্ষর করেছেন।
বাংলা ট্রিবিউনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নূরুজ্জামান বাবু জানান, ন্যায় বিচার পাওয়ার আশায় এজাহারটি থানায় দাখিল করা হয়েছে। এজাহারটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এমন প্রত্যাশাই করছি।
এ বিষয়ে ওসি মাহফুজার রহমান বলেন, আরিফুল ইসলাম রিগ্যানের পাঠানো অভিযোগটি পেয়েছি। এখন আইনগত প্রক্রিয়া শেষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুলতানা পারভীন ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা এখন কুড়িগ্রামের পুলিশের হাতে। দেশবাসীর প্রত্যাশা, কুড়িগ্রাম পুলিশও অবশেষে যেন কোন ভাইরাসে আক্রান্ত না হন। আবার পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারাও যেন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কুড়িগ্রাম পুলিশকে যথাযথ তদন্ত দ্রুত সম্পন্ন না করতে চাপ প্রয়োগ না করেন। এখন পুলিশ, সাক্ষী, বিচারক সবার সাহসী এবং আইনগত পদক্ষেপ সকল পর্যায়েই প্রত্যাশিত।
ভাইরাস আক্রান্ত ডিসির খবর বেশী একটা পাওয়া যায় না। তবে আমার মনে পাবনা জেলা দায়রা জজ আদালতে পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক দুনীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন। তখন ঐ জেলা প্রশাসক তাঁর পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য ঢাকা থেকে নামীদামী আইনজীবী এনেছিলেন কিন্তু কুলরক্ষা হয় নি। পাবনা জেলার দায়রা বিচারক ঐ জেলা প্রশাসককে তিন বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করেছিলেন।
অতঃপর ঐ জেলা প্রশাসক ঐ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল দায়ের করে জামিনের প্রার্থনা জানিয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। শুনানী অন্তে হাইকোর্ট জেলা জজ আদালতের রায় বহাল রাখেন। অতঃপর তিনি সুপ্রিম কোর্টে আপিল দায়ে করেও তাঁর অনুকুলে কোন রায় পাননি। সর্বোচ্চ আদালত ও পাবনা জেলা দায়রা জজ আদালতের রায় হুবহু বহাল রাখেন।
আর একজন জেলা প্রশাসক অতি সম্প্রতি নারী ভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে অনুরূপ বদলি হয়ে ওএসডি হয়েছিলেন। ঘটনাটি ছিল জামালপুরের। জামালপুরের সেই ডিসির অতীতের অনেক ঘটনার মতই, আজ আর কোন খবর নেই। সম্ভবতঃ ঊর্ধতন কর্মকর্তারা, তদন্তে ঐ ডিসির নারী ভাইরাসের অীভযোগ সত্য প্রমাণিত হওয়া সত্বেও, ভিকটিম মহিলা কর্মচারীটি তাঁর ডিসির বিরুদ্ধে তাঁর যৌন অপরাধের দায়ে সাহস করে মামলা দায়ের না করায় ঊর্দ্ধতন ভাইরাস আক্রান্ত কর্মকর্তারা অভিযুক্ত ডিসিকে রেহাই দিয়েছেন। হয়তো বা ইতোমধ্যে তাঁর পদোন্নতিও ঘটেছে ভিকটিম মহিলা মামলা না করার সুযোগে।
বাংলা ট্রিবিউনকে ধন্যবাদ তাঁরা তাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগ্যানের বিপদে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। অভিনন্দন জানাই আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে সাহস করে ঐ এজাহারে ভাঙ্গা হাতে স্বাক্ষর দিয়ে হাসপাতাল বেডে শুয়েও বিচার প্রার্থী হওয়ার জন্যে।
এবারে কুড়িগ্রামের সাংবাদিক বন্ধুদের প্রতি আবেদন তাঁরা যেন অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে শেষ পর্যন্ত রিগ্যানের পাশে ঐক্যবদ্ধভাবে থাকেন। কুড়িগ্রামের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সেখানকার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অঙ্গণের সবাই যেন অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ন্যায় বিচার আদায়ের দাবীতে ঐক্যবদ্ধ থাকেন-কুড়িগ্রামের সকল সুধী সমাজও যেন রিগ্যানের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে কুড়িগ্রামের মর্যাদা সমুন্নত রাখেন।
এবারে আমার আবেদন বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল সাংবাদিকের প্রতি তাঁরা যেন রিগ্যানকে অতি আপন মনে করে কুগিগ্রামের সাবেক ডিসি ভাইরাস আক্রান্ত সুলতানা পারভীন ও অপরাপরকে দ্রুত গ্রেফতারত, ন্যায় বিচার ও রিগ্যানের সরকারি ব্যয়ে উন্নত চিকিৎসা এবং তার যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায়ে দেশব্যাপী ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করেন। এই ক্ষেত্রে অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার মধ্যেই কিন্তু নিহিত রয়েছে সাংবাদিকদের মর্যাদা সংরক্ষণ এবং অসৎ, দুর্নীতি পরায়ণ আমলাদের হাত থেকে অসহায় নির্যাতীত মানুষকে রক্ষা করা এবং আইনের শাসন সমুন্নত রাখা।
জয় হোক আইনের। জয় হোক সুলতানা পারভীন ভাইরাস প্রতিরোধ সংগ্রামের, জয়হোক সাংবাদিক সমাজের, জয় হোক আইনের শাসনের।
রণেশ মৈত্র
(একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক)
সভাপতিমন্ডলী সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।