আজ ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০০ তম জন্মদিন
- প্রকাশিত সময় ০৬:৫৪:৩৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০
- / 122
২৬ শে সেপ্টেম্বর ২০২০, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০০ তম জন্মদিন আজ, এই দিনেই বাংলায় নবজাগরণের রূপকার ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজ পরিবর্তনের এক সুনিপূণ শিল্পী। তিনি বাঙালি পন্ডিত, সমাজ সংস্কারক ও নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রদ্যূত ছিলেন। মানবসেবায় তার মানবিক গুণাবলির প্রকাশ তাকে করেছে অনন্য। তার সূনিপূণ রচনাশৈলী বাংলা গদ্য সাহিত্যকে পরিপূর্ণতা দান করেছে।
তার প্রথম জীবনের নাম ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। তিনি ভারতের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর এক সাহিত্যিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
ছোটবেলায় তিনি নিজ গ্রামেই পড়াশোনা শুরু করেন। সেখান থেকে বাবার হাত ধরে কোলকাতায় চলে আসেন। ছাত্র জীবনে অনন্য মেধার কারণে তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। বেহাল অবস্থা ছিল বাংলা গদ্য সাহিত্যের। তার সুনিপূণ রচনাশৈলীতে বাংলা গদ্য সাহিত্যে প্রাঞ্জলতা ফিরে আসে।
গদ্য সাহিত্যকে একটি মানসম্পন্ন সাহিত্যে পৌছিয়ে দিতে তার পান্ডিত্য বড় ভূমিকা রেখেছে। ১৮৫০ সালে বাংলা ব্যাকরণের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত কৌমুদী প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়।
বাংলা সাহিত্যে এই প্রথম নিয়মরীতি অনুসরণ করে ব্যাকরণ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় যার মধ্যদিয়ে সাহিত্যমোদীদের দীর্ঘদিনের একটি স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। একদিকে বাংলা সাহিত্যের ব্যাকরণ গ্রন্থ নির্মাণ অপরদিকে মানসম্পন্ন গদ্য সাহিত্য তৈরীতে তার অনন্য ভূমিকায় মুগ্ধ হয়ে হিন্দু ল কমিটি তাকে ‘ বিদ্যাসাগর’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
ভারতবর্ষে সতীদাহ প্রথা বন্ধ হলেও বিধবা মহিলাদের জীবন যাপন ও নানা সুবিধা- অসুবিধা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তারা নিজ বাড়ীতে নিগৃত হতে থাকে। এই সামাজিক সমস্যা ছোট থেকে প্রকট আকার ধারণ করে। সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন ঈশ্বরচন্দ্রবিদ্যাসাগর।
তিনি বিধবা বিবাহের পক্ষে সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন। এ ব্যাপারে তার নিজস্ব মতামত মানুষের কাছে তুলে ধরতে ‘সোম প্রকাশ’ নাম দিয়ে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। কৌশগত কারণেই তিনি এই পত্রিকাটির সামনের ফ্রন্টে না থেকে পিছন থেকে সবকিছুই করেছেন।
হিন্দু সমাজের দীর্ঘদিনের এই প্রথা ভাঙ্গতে গিয়ে তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন। অনেকেই বলতে থাকেন তার নিজের ছেলেকে দিয়ে বিধবা বিবাহের প্রচলন শুরু করতে পারেন।
সমালোচকদের এই কথার প্রেক্ষিতে তিনি তার ছেলে নারায়ণচন্দ্রকে এক বিধবা ভাগ্যহীনার সাথে বিয়ে দিয়ে সমালোচকদের মুখে চুনকালি ছুড়ে দেন। সেই থেকে ভারতবর্ষে বিধবা বিবাহের প্রচলন শুরু হয়। তিনি বহুবিবাহ এবং বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধেও সামাজিক আন্দোলন করে গেছেন।
ভারতবর্ষকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে রুপান্তর করতে প্রথমেই প্রয়োজন নারী ও পুরুষের ভেদাভেদ কমিয়ে আনা। এই ভাবনাকে হৃদয়ে ধারণ করেই তিনি নারী অধিকার আন্দোলনকে বেগবান করতে চেষ্ঠা করেছেন।
প্রথমেই নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়ে এগিয়ে আসেন। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ড্রিংকওয়াটার বিটন কোলকাতায় একটি হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে মেয়েদের শিক্ষাকার্যক্রম শুরু করেন। এটি ভারতবর্ষের মধ্যে প্রথম মেয়েদের জন্য শিক্ষালয়। এই শিক্ষালয়ের সম্পাদক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্রবিদ্যাসাগর নিজে।
বর্তমানে ‘বেথুন স্কুল’ হিসাবে এই শিক্ষালয়টি পরিচিত। ঈশ্বরচন্দ্রবিদ্যাসাগর পশ্চিমবঙ্গে নারী শিক্ষা আন্দোলনকে বেগবান করতে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। যার মধ্যদিয়ে ভারতবর্ষে নারী শিক্ষার দ্রুত প্রসার ঘটে।
১৮৬৪ সালে ভারতবর্ষে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। চারিদিকে মানুষের করুণ আর্তনাদ তার মনের মধ্যে বাজতে থাকে। এ সময় তিনি আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি। তার নিজের এলাকায় একটি আশ্রম খোলে প্রতিদিন সেখানে ৫ থেকে ৬’শ শিশুসহ নারী পুরুষের খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অর্থ্যাৎ প্রায় ৫ মাস বিনামূল্যে তিনি এই সকল দুঃস্থ ও অনাথদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। শুধু খাওয়ার নয় পাশাপাশি চিকিৎসার ব্যবস্থা করে এক অনন্য মানবিক দৃষ্ঠান্ত স্থাপন করেছেন। যে কোন মানুষ তার কাছে সাহায্য চাইতে আসলে তিনি কখনো খালি হাতে ফেরাতেন না।
ফ্রান্সে থাকাকালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত অর্থ সংকটে পড়েন। তিনি বিদ্যাসাগরের কাছে তার অভাবের কথা জানিয়ে চিঠি লিখেন। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগর সেই সময় ১৫০০ টাকা মাইকেলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
ঈশ্বরচন্দ্রবিদ্যাসাগর তার বৈচিত্রময় জীবনে বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। যে গুলি বাংলা সাহিত্যের ক্রমবর্ধমান ধারাবাহিকতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে বর্ণপরিচয়, ব্যাকরণ কৌমুদী, শকুন্তলা, সীতার বনবাস, বাঙালার ইতিহাস।
নানা গুণে গুণাণিত এই মানুষটির অবদান একবিংশ শতাব্দীতে এসেও শেষ হয়নি। বাংলা সাহিত্যমোদীদের কাছে তিনি শুধুই সাহিত্যের পন্ডিতই নয় একজন সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম রুপকার হিসাবে পরিচিতি পেয়েছেন। ফলে তার অবদান বাঙালি সমাজ যুগ যুগ ধরে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।