ঢাকা ১২:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞপ্তি :
সারাদেশের জেলা উপোজেলা পর্যায়ে দৈনিক স্বতঃকণ্ঠে সংবাদকর্মী নিয়োগ চলছে । আগ্রহী প্রার্থীগন জীবন বৃত্তান্ত ইমেইল করুন shatakantha.info@gmail.com // দৈনিক স্বতঃকণ্ঠ অনলাইন ও প্রিন্ট পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন ০১৭১১-৩৩৩৮১১, ০১৭৪৪-১২৪৮১৪

মৃত্যুগুলি সবই কি অনিবার্য? সিডনীর কথকতা-৩২

বার্তাকক্ষ
  • প্রকাশিত সময় ০৯:০২:৩৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুলাই ২০১৮
  • / 136

 

বিগত ২৩ মার্চ সকালে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বসেছিলাম টেলিভিশনে বাংলাদেশের সকালের খবর দেখতে। মনটা দুঃখ ভারাক্রান্ত ছিল এ কারণে যে আমাদের মেজ মেয়ে কুমকুম (মালবিকা) ঢাকাতে গুরুতর অসুস্থ এবং দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছে আজ তিনদিন যাবত। তার আগে, বস্তুত: অন্তত: ৭/৮ টি বছর ধরেই তার চিকিৎসা চলেছে-মাসের পর মাস হাসপাতাল থেকে বাসায় আসার পর তিন থেকে সাত দিনের মধ্যেই পুনরায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে।

এই দফায় কুমকুম খেতে তো দূরের কথা, সামান্যতম কথা বলতেও পারছিল না। জ্ঞান অবশ্য ছিল অন্যের কথাও শুনতে এবং বুঝতে পারতো কিন্তু কোন কথা বলতে পারছিল না। তাই জরুরী ভিত্তিতে গত ২১ জুন দুপুরে তাকে স্কয়ার হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ভর্তি করলে তৎক্ষণাৎ তাকে আই.সি.ইউ. তে স্থানান্তরিত করা হয় চিকিৎসকের নির্দেশে। জানিনা মেয়েটির পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। জামাতা গৌতম, ছেলে প্রলয়,পুত্রবধূ কল্যাণী, নাতি পৃথ্বীরাজ অহোরাত্র হাসপাতালে তার দেখ ভালে ব্যস্ত। দূরদেশে থাকায় আমরা চোখের দেখাও দেখতে না পারায় মেয়েটির অবস্থা কি হবে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভেবেই এমন দুশ্চিন্তায় ভুগছি পরিবারের সবাই। তবে সিডনী প্রবাসী বড় ছেলে প্রবীর তার বোনটির চিকিৎসার জন্য সাধ্যাতীত করছে এটুকুই সান্তনা।

এহেন পরিস্থিতিতে দূরদেশে থেকে মানসিক অবস্থা যা দাঁড়ায় তা সহজেই কল্পনা করা যায়। এনিয়েই টেলিভিশন খুলতেই ব্রেকিং নিউজ দেখে চোখ আটকালো। ব্রেকিং নিউজে বারবার দেখানো হচ্ছে, গাইবান্ধা জেলার পলাশ বাড়ীতে যাত্রীবাহী চলন্ত বাস উল্টে খাদে পড়ে ১৬জন নিহত ও অন্তত: ৩০ জন আহত। রংপুরের পাগলাপীরে ট্রাক চাপা পড়ে ৬ জন নিহত ১০ জন আহত। কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই দেখালো রংপুর, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ সড়ক দুর্ঘটনায় ১০ জন নিহত। খবরগুলি দেখলাম সকাল সাড়ে সাত থেকে আটটার মধ্যে (বাংলাদেশ সময়) আর সিডনী সময় বেলা ১১-৩০ মি. থেকে ১২ টার মধ্যে।

ভাবলাম, দিনটা তো কেবল সুরু হলো। ভোর থেকে এই দু’তিন ঘন্টার মধ্যেই যদি পর পর সংঘটিত দুর্ঘটনায় ৩২ টি মৃত্যুর ও ৪০ জন আহত (গুরুতর আহত কত জন তা অবশ্য ঐ সংবাদে উল্লেখ করা হয় নি) সর্বশেষ খবরে জানলাম ২৩ জুন তারিখে একমাত্র “সড়ক দুর্ঘটনা”তেই সমগ্র বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৮এ। আহত হয়েছেন প্রায় ৮০ জন। এই আহতদের মধ্যে যাঁরা গুরুতর আহত তাঁদের মধ্যেও অনেকের মৃত্যু ঘটার আশংকা আছে। সবশেষে জানা গেল ঐ দিনকার সড়ক দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যুর শিকার হতে হয়েছে মোটমাট ৬৪ জনকে। ফেসবুক থেকে এই তথ্য জেনে কমেন্ট করতে বাধ্য হয়ে লিখেছি, “যে কোন সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজে এর পর নিশ্চয়ই সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রী পদত্যাগ করতেন তাঁর দায়িতদ্ব পালনে, সড়কগুলি চওড়া করণে, সততার সাথে চালকেরা যাতে লাইসেন্স পান তা নিশ্চিত করণে ও ফিটনেসবিহীন গাড়ী চলাচল বন্ধকরণে তাঁর ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে।”

যে কথাগুলি লিখছি তা কোন পুরাতন কথা নয়। রাস্তাগুলি সংকীর্ণ থাকলে, টাকার বিনিময়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরণ করা হলে, ফিটনেস বিহীন লক্কর-ঝক্কর মার্কা যান-বাহন সড়কগুলিতে চলাচল করলে সড়ক ‘দুর্ঘটনা’ প্রতিদরোধ কিভাবে হবে? এগুলি দেখভাল, তদারকি এবং সর্বোপরি নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা তো একদিনের নয়-দশকের পর দশক এই দুর্ভোগ জাতিকে পোহাতে হচ্ছে। নিরপরাধ যাত্রীদেরকে টাকার বিনিময়ে গাড়ীতে চড়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানের আগেই তাঁদের জীবন প্রদীপ নির্বাপিত হচ্ছে। আর এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে কারও কোন জবাবদিহিতা থাকবে না তা ভাবতেও অবাক লাগে।

অতি দ্রুত গাড়ি চালানো বে-আইনী এবং মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্বেও যে সকল চালক তা করেন এবং ফলে অজশ্র প্রাণহানি ঘটছে সেগুলি এবং পূর্বে উল্লেখিত দুটি কারণে যে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হচ্ছে কোন যুক্তিতে সেগুলিকে ‘দূর্ঘটনা’ বলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব? অথচ তার জন্যে আদালত পর্য্যন্ত মামলা যেতেই পারে না প্রভাবশালীদের অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে। স্পষ্টত:ই এগুলিকে হত্যা বলে আইনে বর্ণিত হওয়া প্রয়োজন এবং জনমতও তাই মনে করে থাকেন। এ হত্যালীলা তা হলে প্রতি সপ্তাহে কতজন, প্রতিমাসে কতজন ও প্রতি বছরের কতজনের প্রাণসংহার ঘটাচ্ছে তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।

তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি মন্ত্রীসভার সাপ্তাহিক নিয়মিত সভায় দূরাপাল্লার গাড়ীগুলিতে দু‘জন করে চালক রাখাসহ কতিপয় নির্দেশনা দিয়েছেন। দেখা যাক তাতে কতটা উনড়বতি সূচিত হয়। তবে আমার মতে এগুলি ছাড়াও রাস্তা প্রশস্তকরণ, প্রশিক্ষিত চালক এবং বাধ্যতামূলকভাবে গাড়ীর আসন সংখ্যা ও যাত্রী সংখ্যা যেন সমান থেকে বেশী না হয় এবং বিস্তর রেল লাইন নির্মান ও রেল গাড়ীগুলিতে অধিক সংখ্যক বগি সংযোজন এবং রেল গাড়ীর সংখ্যা সকল রুটেই কমপক্ষে দ্বিগুন করা অপরিহার্য্য প্রয়োজন। তার সাথে দোষী চালকদের কঠোর শাস্তি বিধান, চালকদের বিশ্রাম ও উপযুক্ত বেতন ভাতা এবং নিয়োগপত্র প্রদান চালু করার বিকল্প নেই-যদি আমরা কার্য্যকরভাবে নিরাপদ সড়ক যাত্রা নিশ্চিত করতে প্রকৃতই আগ্রহী হই। একই সাথে লাইসেন্স প্রদানে দুর্নীতি এবং বে-আইনী দাবীতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনও কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। সর্বত্র বি আর টি সির গাড়ীর সংখ্যাও ব্যাপকভাবে বাড়ানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে একজন মন্ত্রীর মন্তব্যও প্রশড়ববিদ্ধ।

মৃত্যুর মিছিল শুধুমাত্র সড়কেই সীমাবদ্ধ নয়। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অভিযান যেমন সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য অতীত প্রয়োজনীয় তেমনই ঐ অভিযানের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যালীলায় সমগ্র জাতি ও সচেতন সমাজ সংকিত ও বিক্ষুব্ধ। এক্ষেত্রে পুলিশের একাংশ রীতিমত গ্রেফতার বাণিজ্যও চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগের অন্ত নেই। তারপরেও বাঘা বাঘা মাদক ব্যবসায়ীরা ধরা পড়ছে না কেউ বিদেশে অবাধে যেতে পারছে আবার কেউ বা নিশেষ বিশেষ ব্যক্তির আশ্রয়ে থেকে দিব্যি নিরাপদে ঘুরে বেড়াচ্ছে এমন অভিযোগও ব্যাপক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ নিরাপক্ষতা অবলম্বন করে অবিলম্বে সকল সাদক সম্রাটকে গ্রেফতারের ব্যাপারে অধিকতর তৎপর হতে হবে একই সাথে দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদেরকেও আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তথাকথিত ‘বন্দুক যুদ্ধে’র নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের অবসানও ঘটাতে হবে। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণের অভিযান চালাতে অত্যধিক বিলম্ব হওয়ায় অসংখ্য মাদক সম্রাটের জন্ম হতে পেরেছে হাজার হাজার যুবক-যুবতীর জীবন-যৌবন ধ্বংস হতে পেরেছে। দেশের আনাচে কানাচে এদের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ ঘটেছে। অথচ ঐ সম্রাটরা দিব্যি কেউ কেউ মন্ত্রীসভায়, কেউ কেউ সংসদে কেউ কেউ বড় বড় বিরোধীদলে নেতৃত্বের পর্য্যায়ে স্থান দখল করে নিয়ে দিব্যি বহাল তবিয়তে সমাজ-পতি সেজে বসে আছে। তেমনি তারা আছে পুলিশে, গোয়েন্দা বাহিনীতে এবং সমাজের অন্যান্য ষ্পর্শকাতর স্থানেও। শিক্ষকেরাও শতভাগ ব্যতিক্রম এমন কথাও ভাবার কোন কারণ নেই। এই ভায়বহ পচন থেকে সমাজকে উদ্ধার করা যেমন জরুরী তেমনই আবার কোন মলমে ঐ রোগ সারবে না। রীতিমত সার্জারি চালানো উচিত সর্বত্র।

ব্লগার হত্যা, ‘নাস্তিক’ অভিযানে হত্যা দিব্যি চলছে ধর্মের আড়ালে। ধর্মকে একশ্রেণীর মানুষ বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে তার আড়ালে ভয়াবহ হত্যালীলা, সন্ত্রাস প্রভৃতি আজও চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে-সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিরোধের অভাবে। প্রতিরোধহীনতা, নিস্পৃহতা আমাদের সমাজকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আর সেই সুযোগে সন্ত্রাস দিব্যি বহাল তবিয়েতে চলছে-চলছে বিচার বহির্ভূত হত্যা আইনকে নিজ নিজ হাতে তুলে নিয়ে। এর অবসান আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিরোধ দ্রুত গড়ে তোলার বিকল্প নেই। রাষ্ট্রকে যেমন, সমাজকেও তেমনই ধর্শের নামে বিভ্রম সৃষ্টি করে চালানো সকল হত্যাকান্ড সকল সন্ত্রাসকে প্রতিরোধ কতের আর বিলম্ব করলে নিদারুন ক্ষতি হওয়ার আশংকা অত্যান্ত স্পষ্ট। জাতি এভাবে জ্ঞানীগুনীজনকে তো বধেই একটি প্রাণকেও অপরধী নিরাপরাধ নির্বিশেষ অবৈধ হত্যালীলা বা সন্দ্রাস বাউকেই চালাতে দিতে আর রাজী নয়সমাজ বস্তুত: তাতে কোনদিনই রাজী ছিল না বলেই দেশের আইন কাউকে হাতে তুলে নেওয়ার বিরোধীতা করে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণীত হয়েছে। আমাদের সংবিধানের সাথে শতভাগ সামঞ্জস্য রেখে।

হত্যালীলার শিকার আমাদের নারীদেরকেও হামেশাই হতে হচ্ছে। ফতোয়াবাজদের কল্যাণে বে-আইনী এবং অমানবিক ফতোয়া জারী করে দোররা, জরিমানা, একঘরে করার যেমন অবসান ঘটে নি (কমেছে যদিও)- তেমনই আবার নারীর যৌন-নির্য্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণ জনিত হত্যা, সন্তান-প্রসবে জটিলতা জনিত মৃত্যু, চিকিৎসার অপ্রতুলতা জনিত মৃত্যু, সমাজে অপবাদের ভয়ে আত্মহত্যার কাহিনী যেমন সংবাপত্রে প্রকাশিত হয়ে থাকে প্রকাশিত থাকে তার তিন থেকে চার গুন।

এক্ষেত্রে ফতোয়াবাজদের কঠোর শাস্তি দিয়ে সমাজ থেকে তাদের নির্মূল করা, যৌন নির্য্যাতন কারীদেরকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি বিধান করা, প্রসূতিদের হাসপাতালে প্রসব বাধ্যতামূলক করা, দায়িত্বশীল অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের দ্বারা প্রসব কার্য্য সম্পাদন করে নারী শিশুর অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করাও অপরিাহার্য্য। শিক্ষাক্ষেত্রে পরীক্ষা গ্রহণের এবং নম্বর প্রদানের ক্ষেত্রে যে ভয়াবহ দুর্নীতির তথ্য সম্প্রতি প্রকাশিত হলো তা অত্যন্ত নির্মম এবং ভয়াবহ। অর্থের বিনিময়ে জিপিএ ফাইভ বিμীর কাহিনী আতংকিত করেছে সভ্য সমাজকে। ফাঁসির নীচে এই গুরুতর অপরাধীদের অপর কোন শাস্তি কল্পনাও করা যায় না। কারণ এদের কারণে জাতি মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বঞ্চিত যেমন করছে তেমনই আবার তাদের অনেকের আত্মহত্যায় প্ররোচিতও করছে।

এভাবে সমাজের সকল দিকে সতর্ক দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, সমাজের বহু ক্ষেত্রেই বে-আইনী, অনাকাংখিত হত্যালীলা অব্যাহতভাবে চলছে-যাকে এখনও সমাজ ততটা ভয়াবহ বলে গ্রহণ না করার ফলে রাষ্ট্রীয় সামাজিক প্রতিরোধ তেমন একটা গড়ে উঠছে না। অথচ এই মৃত্যুগুলি কদাপি অনিবার্য্য নয় – নয় ‘বিধাতার’ আকাংখার প্রতিফলনও।

বিএনপির একজন মন্ত্রী একদা এমন এক হত্যালীলার খবর জানালে বলেছিলেন, “আল্লাহ মাল আল্লাহ নিছে”। আজ এমন কথা কেউ উচ্চারণ না করলেও মনের গভীরে অনেকে যে তেমনি মনোভাবই অপ্রকাশ্যে লালন করে চলেছেন কার্য্যত: তারই প্রকাশ ঘটে চলেছে। এই নিয়ন্ত্রযোগ্য হত্যালীলার অবসান কাম্য।

লেখক, রণেশ মৈত্র
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
(সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত)

মৃত্যুগুলি সবই কি অনিবার্য? সিডনীর কথকতা-৩২

প্রকাশিত সময় ০৯:০২:৩৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুলাই ২০১৮

 

বিগত ২৩ মার্চ সকালে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বসেছিলাম টেলিভিশনে বাংলাদেশের সকালের খবর দেখতে। মনটা দুঃখ ভারাক্রান্ত ছিল এ কারণে যে আমাদের মেজ মেয়ে কুমকুম (মালবিকা) ঢাকাতে গুরুতর অসুস্থ এবং দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছে আজ তিনদিন যাবত। তার আগে, বস্তুত: অন্তত: ৭/৮ টি বছর ধরেই তার চিকিৎসা চলেছে-মাসের পর মাস হাসপাতাল থেকে বাসায় আসার পর তিন থেকে সাত দিনের মধ্যেই পুনরায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে।

এই দফায় কুমকুম খেতে তো দূরের কথা, সামান্যতম কথা বলতেও পারছিল না। জ্ঞান অবশ্য ছিল অন্যের কথাও শুনতে এবং বুঝতে পারতো কিন্তু কোন কথা বলতে পারছিল না। তাই জরুরী ভিত্তিতে গত ২১ জুন দুপুরে তাকে স্কয়ার হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ভর্তি করলে তৎক্ষণাৎ তাকে আই.সি.ইউ. তে স্থানান্তরিত করা হয় চিকিৎসকের নির্দেশে। জানিনা মেয়েটির পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। জামাতা গৌতম, ছেলে প্রলয়,পুত্রবধূ কল্যাণী, নাতি পৃথ্বীরাজ অহোরাত্র হাসপাতালে তার দেখ ভালে ব্যস্ত। দূরদেশে থাকায় আমরা চোখের দেখাও দেখতে না পারায় মেয়েটির অবস্থা কি হবে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভেবেই এমন দুশ্চিন্তায় ভুগছি পরিবারের সবাই। তবে সিডনী প্রবাসী বড় ছেলে প্রবীর তার বোনটির চিকিৎসার জন্য সাধ্যাতীত করছে এটুকুই সান্তনা।

এহেন পরিস্থিতিতে দূরদেশে থেকে মানসিক অবস্থা যা দাঁড়ায় তা সহজেই কল্পনা করা যায়। এনিয়েই টেলিভিশন খুলতেই ব্রেকিং নিউজ দেখে চোখ আটকালো। ব্রেকিং নিউজে বারবার দেখানো হচ্ছে, গাইবান্ধা জেলার পলাশ বাড়ীতে যাত্রীবাহী চলন্ত বাস উল্টে খাদে পড়ে ১৬জন নিহত ও অন্তত: ৩০ জন আহত। রংপুরের পাগলাপীরে ট্রাক চাপা পড়ে ৬ জন নিহত ১০ জন আহত। কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই দেখালো রংপুর, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ সড়ক দুর্ঘটনায় ১০ জন নিহত। খবরগুলি দেখলাম সকাল সাড়ে সাত থেকে আটটার মধ্যে (বাংলাদেশ সময়) আর সিডনী সময় বেলা ১১-৩০ মি. থেকে ১২ টার মধ্যে।

ভাবলাম, দিনটা তো কেবল সুরু হলো। ভোর থেকে এই দু’তিন ঘন্টার মধ্যেই যদি পর পর সংঘটিত দুর্ঘটনায় ৩২ টি মৃত্যুর ও ৪০ জন আহত (গুরুতর আহত কত জন তা অবশ্য ঐ সংবাদে উল্লেখ করা হয় নি) সর্বশেষ খবরে জানলাম ২৩ জুন তারিখে একমাত্র “সড়ক দুর্ঘটনা”তেই সমগ্র বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৮এ। আহত হয়েছেন প্রায় ৮০ জন। এই আহতদের মধ্যে যাঁরা গুরুতর আহত তাঁদের মধ্যেও অনেকের মৃত্যু ঘটার আশংকা আছে। সবশেষে জানা গেল ঐ দিনকার সড়ক দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যুর শিকার হতে হয়েছে মোটমাট ৬৪ জনকে। ফেসবুক থেকে এই তথ্য জেনে কমেন্ট করতে বাধ্য হয়ে লিখেছি, “যে কোন সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজে এর পর নিশ্চয়ই সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রী পদত্যাগ করতেন তাঁর দায়িতদ্ব পালনে, সড়কগুলি চওড়া করণে, সততার সাথে চালকেরা যাতে লাইসেন্স পান তা নিশ্চিত করণে ও ফিটনেসবিহীন গাড়ী চলাচল বন্ধকরণে তাঁর ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে।”

যে কথাগুলি লিখছি তা কোন পুরাতন কথা নয়। রাস্তাগুলি সংকীর্ণ থাকলে, টাকার বিনিময়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরণ করা হলে, ফিটনেস বিহীন লক্কর-ঝক্কর মার্কা যান-বাহন সড়কগুলিতে চলাচল করলে সড়ক ‘দুর্ঘটনা’ প্রতিদরোধ কিভাবে হবে? এগুলি দেখভাল, তদারকি এবং সর্বোপরি নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা তো একদিনের নয়-দশকের পর দশক এই দুর্ভোগ জাতিকে পোহাতে হচ্ছে। নিরপরাধ যাত্রীদেরকে টাকার বিনিময়ে গাড়ীতে চড়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানের আগেই তাঁদের জীবন প্রদীপ নির্বাপিত হচ্ছে। আর এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে কারও কোন জবাবদিহিতা থাকবে না তা ভাবতেও অবাক লাগে।

অতি দ্রুত গাড়ি চালানো বে-আইনী এবং মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্বেও যে সকল চালক তা করেন এবং ফলে অজশ্র প্রাণহানি ঘটছে সেগুলি এবং পূর্বে উল্লেখিত দুটি কারণে যে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হচ্ছে কোন যুক্তিতে সেগুলিকে ‘দূর্ঘটনা’ বলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব? অথচ তার জন্যে আদালত পর্য্যন্ত মামলা যেতেই পারে না প্রভাবশালীদের অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে। স্পষ্টত:ই এগুলিকে হত্যা বলে আইনে বর্ণিত হওয়া প্রয়োজন এবং জনমতও তাই মনে করে থাকেন। এ হত্যালীলা তা হলে প্রতি সপ্তাহে কতজন, প্রতিমাসে কতজন ও প্রতি বছরের কতজনের প্রাণসংহার ঘটাচ্ছে তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।

তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি মন্ত্রীসভার সাপ্তাহিক নিয়মিত সভায় দূরাপাল্লার গাড়ীগুলিতে দু‘জন করে চালক রাখাসহ কতিপয় নির্দেশনা দিয়েছেন। দেখা যাক তাতে কতটা উনড়বতি সূচিত হয়। তবে আমার মতে এগুলি ছাড়াও রাস্তা প্রশস্তকরণ, প্রশিক্ষিত চালক এবং বাধ্যতামূলকভাবে গাড়ীর আসন সংখ্যা ও যাত্রী সংখ্যা যেন সমান থেকে বেশী না হয় এবং বিস্তর রেল লাইন নির্মান ও রেল গাড়ীগুলিতে অধিক সংখ্যক বগি সংযোজন এবং রেল গাড়ীর সংখ্যা সকল রুটেই কমপক্ষে দ্বিগুন করা অপরিহার্য্য প্রয়োজন। তার সাথে দোষী চালকদের কঠোর শাস্তি বিধান, চালকদের বিশ্রাম ও উপযুক্ত বেতন ভাতা এবং নিয়োগপত্র প্রদান চালু করার বিকল্প নেই-যদি আমরা কার্য্যকরভাবে নিরাপদ সড়ক যাত্রা নিশ্চিত করতে প্রকৃতই আগ্রহী হই। একই সাথে লাইসেন্স প্রদানে দুর্নীতি এবং বে-আইনী দাবীতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনও কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। সর্বত্র বি আর টি সির গাড়ীর সংখ্যাও ব্যাপকভাবে বাড়ানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে একজন মন্ত্রীর মন্তব্যও প্রশড়ববিদ্ধ।

মৃত্যুর মিছিল শুধুমাত্র সড়কেই সীমাবদ্ধ নয়। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অভিযান যেমন সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য অতীত প্রয়োজনীয় তেমনই ঐ অভিযানের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যালীলায় সমগ্র জাতি ও সচেতন সমাজ সংকিত ও বিক্ষুব্ধ। এক্ষেত্রে পুলিশের একাংশ রীতিমত গ্রেফতার বাণিজ্যও চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগের অন্ত নেই। তারপরেও বাঘা বাঘা মাদক ব্যবসায়ীরা ধরা পড়ছে না কেউ বিদেশে অবাধে যেতে পারছে আবার কেউ বা নিশেষ বিশেষ ব্যক্তির আশ্রয়ে থেকে দিব্যি নিরাপদে ঘুরে বেড়াচ্ছে এমন অভিযোগও ব্যাপক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ নিরাপক্ষতা অবলম্বন করে অবিলম্বে সকল সাদক সম্রাটকে গ্রেফতারের ব্যাপারে অধিকতর তৎপর হতে হবে একই সাথে দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদেরকেও আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তথাকথিত ‘বন্দুক যুদ্ধে’র নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের অবসানও ঘটাতে হবে। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণের অভিযান চালাতে অত্যধিক বিলম্ব হওয়ায় অসংখ্য মাদক সম্রাটের জন্ম হতে পেরেছে হাজার হাজার যুবক-যুবতীর জীবন-যৌবন ধ্বংস হতে পেরেছে। দেশের আনাচে কানাচে এদের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ ঘটেছে। অথচ ঐ সম্রাটরা দিব্যি কেউ কেউ মন্ত্রীসভায়, কেউ কেউ সংসদে কেউ কেউ বড় বড় বিরোধীদলে নেতৃত্বের পর্য্যায়ে স্থান দখল করে নিয়ে দিব্যি বহাল তবিয়তে সমাজ-পতি সেজে বসে আছে। তেমনি তারা আছে পুলিশে, গোয়েন্দা বাহিনীতে এবং সমাজের অন্যান্য ষ্পর্শকাতর স্থানেও। শিক্ষকেরাও শতভাগ ব্যতিক্রম এমন কথাও ভাবার কোন কারণ নেই। এই ভায়বহ পচন থেকে সমাজকে উদ্ধার করা যেমন জরুরী তেমনই আবার কোন মলমে ঐ রোগ সারবে না। রীতিমত সার্জারি চালানো উচিত সর্বত্র।

ব্লগার হত্যা, ‘নাস্তিক’ অভিযানে হত্যা দিব্যি চলছে ধর্মের আড়ালে। ধর্মকে একশ্রেণীর মানুষ বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে তার আড়ালে ভয়াবহ হত্যালীলা, সন্ত্রাস প্রভৃতি আজও চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে-সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিরোধের অভাবে। প্রতিরোধহীনতা, নিস্পৃহতা আমাদের সমাজকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আর সেই সুযোগে সন্ত্রাস দিব্যি বহাল তবিয়েতে চলছে-চলছে বিচার বহির্ভূত হত্যা আইনকে নিজ নিজ হাতে তুলে নিয়ে। এর অবসান আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিরোধ দ্রুত গড়ে তোলার বিকল্প নেই। রাষ্ট্রকে যেমন, সমাজকেও তেমনই ধর্শের নামে বিভ্রম সৃষ্টি করে চালানো সকল হত্যাকান্ড সকল সন্ত্রাসকে প্রতিরোধ কতের আর বিলম্ব করলে নিদারুন ক্ষতি হওয়ার আশংকা অত্যান্ত স্পষ্ট। জাতি এভাবে জ্ঞানীগুনীজনকে তো বধেই একটি প্রাণকেও অপরধী নিরাপরাধ নির্বিশেষ অবৈধ হত্যালীলা বা সন্দ্রাস বাউকেই চালাতে দিতে আর রাজী নয়সমাজ বস্তুত: তাতে কোনদিনই রাজী ছিল না বলেই দেশের আইন কাউকে হাতে তুলে নেওয়ার বিরোধীতা করে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণীত হয়েছে। আমাদের সংবিধানের সাথে শতভাগ সামঞ্জস্য রেখে।

হত্যালীলার শিকার আমাদের নারীদেরকেও হামেশাই হতে হচ্ছে। ফতোয়াবাজদের কল্যাণে বে-আইনী এবং অমানবিক ফতোয়া জারী করে দোররা, জরিমানা, একঘরে করার যেমন অবসান ঘটে নি (কমেছে যদিও)- তেমনই আবার নারীর যৌন-নির্য্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণ জনিত হত্যা, সন্তান-প্রসবে জটিলতা জনিত মৃত্যু, চিকিৎসার অপ্রতুলতা জনিত মৃত্যু, সমাজে অপবাদের ভয়ে আত্মহত্যার কাহিনী যেমন সংবাপত্রে প্রকাশিত হয়ে থাকে প্রকাশিত থাকে তার তিন থেকে চার গুন।

এক্ষেত্রে ফতোয়াবাজদের কঠোর শাস্তি দিয়ে সমাজ থেকে তাদের নির্মূল করা, যৌন নির্য্যাতন কারীদেরকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি বিধান করা, প্রসূতিদের হাসপাতালে প্রসব বাধ্যতামূলক করা, দায়িত্বশীল অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের দ্বারা প্রসব কার্য্য সম্পাদন করে নারী শিশুর অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করাও অপরিাহার্য্য। শিক্ষাক্ষেত্রে পরীক্ষা গ্রহণের এবং নম্বর প্রদানের ক্ষেত্রে যে ভয়াবহ দুর্নীতির তথ্য সম্প্রতি প্রকাশিত হলো তা অত্যন্ত নির্মম এবং ভয়াবহ। অর্থের বিনিময়ে জিপিএ ফাইভ বিμীর কাহিনী আতংকিত করেছে সভ্য সমাজকে। ফাঁসির নীচে এই গুরুতর অপরাধীদের অপর কোন শাস্তি কল্পনাও করা যায় না। কারণ এদের কারণে জাতি মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বঞ্চিত যেমন করছে তেমনই আবার তাদের অনেকের আত্মহত্যায় প্ররোচিতও করছে।

এভাবে সমাজের সকল দিকে সতর্ক দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, সমাজের বহু ক্ষেত্রেই বে-আইনী, অনাকাংখিত হত্যালীলা অব্যাহতভাবে চলছে-যাকে এখনও সমাজ ততটা ভয়াবহ বলে গ্রহণ না করার ফলে রাষ্ট্রীয় সামাজিক প্রতিরোধ তেমন একটা গড়ে উঠছে না। অথচ এই মৃত্যুগুলি কদাপি অনিবার্য্য নয় – নয় ‘বিধাতার’ আকাংখার প্রতিফলনও।

বিএনপির একজন মন্ত্রী একদা এমন এক হত্যালীলার খবর জানালে বলেছিলেন, “আল্লাহ মাল আল্লাহ নিছে”। আজ এমন কথা কেউ উচ্চারণ না করলেও মনের গভীরে অনেকে যে তেমনি মনোভাবই অপ্রকাশ্যে লালন করে চলেছেন কার্য্যত: তারই প্রকাশ ঘটে চলেছে। এই নিয়ন্ত্রযোগ্য হত্যালীলার অবসান কাম্য।

লেখক, রণেশ মৈত্র
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
(সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত)