ইরানের পাতা ফাঁদে নেতিনিয়াহু -প্রথম পর্ব
- প্রকাশিত সময় ০১:০৫:৪১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২১ মে ২০২১
- / 233
আসাদুজ্জামান নোহাশআন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
গত ৭ মে এর ইসরাঈল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ছবি যারা আল আকসাতে নামাজ পড়া কে কেন্দ্র করে অঙ্কিত করেছেন তারা হয়তোবা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির ছবি সুষ্পষ্টভাবে চিত্রায়িত করতে রং তুলির ভুল ব্যবহার করেছে। পরিবেশ আগেই তৈরী হয়েছিলো, শুধু একটি উপলক্ষের অভাব ছিলো। আশা করি পাঠক মহল সমকক্ষ ধারনা পাবেন এই লেখায়।
তারিখের ক্রমিক সংখ্যা মার্চ মাসের ৪
আর্ন্তজাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌশুলি ফাতু বেনসুদ ঘোষনা করেন, ২০১৪ সাল হতে ফিলিস্তিনের উপর চালানো সমস্ত হত্যাকান্ডের জন্য তদন্ত করা হবে। ব্যাস এখানেই খেলার সূত্রপাত আর পরিকল্পনাও এখান থেকেই নেওয়া।
এমনিতেই নেতিনিয়াহু রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগতভাবে নিজ দেশে কোনঠাসা। তারপরে আবার পরম বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্পও ক্ষমতা হতে বিদায় নিয়েছেন। সব মিলিয়ে নেতিনিয়াহুর এখন জেলে যাওয়ার উপক্রম। এই ইমেজ সংকটের মধ্যে একটা টোটকা তার দরকার ছিল এবং সেটাই দিয়েদিলেন ফাতু বেনসুদ।
এমনিতে ইসরাঈল আইসিসি এর সদস্য দেশ নয়। এই বিচারের ফলাফলে কোন ইসরাঈলী কর্মকর্তার শাস্তি হবে না, যা হতে পারে তা হলো- বিশ্বের অনান্য দেশ সমূহ ঈসরাইলের প্রতি নাখোশ হবে। আর এর প্রভাব পড়বে তার বৈশ্বিক রাজনীতিতে।
আর নেতিয়ানাহু সম্ভবত সেই কলঙ্ক মাথায় নিতে চান না যার শাসনামলে ইসরাঈলের গায়ে এতা বড় কলঙ্ক লেপটে যায়।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে নেতিনিয়াহু এর বর্তমান অবস্থা। নিজে দুর্নীতির দায়ে আদালতে বিচারের অপেক্ষায়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেন নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব আটকিয়ে দেওয়ার মূল কারন তার দীর্ঘ দিনের বন্ধুকে রক্ষা করা। যদি এই প্রস্তাব পাশ হয় তবে নেতিনিয়াহুর রাজনৈতিক জীবনের কবর রচিত হবে।
তাই নিজের হারানো ইমেজ ফিরে পাওয়ার জন্য ৮ মে ২০২১ সালের রমজান মাসকে বেছে নিলেন নেতিনিয়াহু। রমজান মাস ফিলিস্তিনিদের হত্যার বৈধ্যতম মাস(ইসরাঈলের কাছে)। কারন এ মাসে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করলে অনান্য আরব দেশ সমূহ কোন বাধা দেয় না।
বিশ্ব রাজনীতির খোরোয়াড়রা তৈরি
এ গ্রুপে আছে প্রথমত যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতিয়ত ইরান এবং অনান্য দেশ সমূহের মধ্যে তুরস্ক, রাশিয়া। আর এরই মাঝে নতুন চমক উদিয়মান বিশ্ব মোড়ল চীন।
যুক্তরাষ্ট্র তার হারানো বিশ্ব মোড়লিপনা ফিরে পেতে আরো বেপড়য়া, ধুরন্ধর ও চতুরিপনার আশ্রয় নিচ্ছে। যার উদাহরন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও সৌদি বাদশাহর সাথে নির্বাচিত হওয়ার অনেক পরে ফোনালাপ। তুরস্কের সাথে ফোনালাপ হলেও তার কথাতে হুমকি ছিলো, আর এই বডাইডেনই ২০১৬ সালে তুরস্কের অভ্যুত্থানকে নিরবে সমর্থন দিয়েছেন বলে কথিত আছে।
তাছাড়া ১৯৫৩ সালের পর এই প্রথমবার মার্কিন কোন ঘাটিতে মিসাঈল হামলা হয়েছে ইরানের দ্বারা, এতে যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদা অনেকখানি কমে গেছে। দূঃস্বপ্ন হয়ে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সিরিয়াতে তাদের ভুল পলিসি, ইরাকে টিকতে না পারা আর তালেবানের সাথে পরাজয় মেনে আফগানস্থান থেকে সন্য প্রত্যাহার। মরার পড়ে খাড়ার ঘা হয়ে উঠছে উপসাগরীয় এলাকায় ইরানের দূঃসাহসিক কর্মকান্ড। কখনও মার্কিন যুদ্ধ জাহাজ কে হুমকি দিয়ে অথবা মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে।
ফিলিস্তিনিদের এই যুদ্ধ র্দীঘায়িত করার অন্যতম কারন হলো মিডিয়াকে ব্যতিব্যস্ত রাখা যাতে ভিয়েনাতে ইরানের সাথে যে পরমাণু চুক্তি হচ্ছে তাতে যুক্তরাষ্টের যে কুটতৈনিক পরাজয় হচ্ছে তা যেন মিডিয়া কাভারেজ না পায়।
ইরান হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনীতির বড় খেলোয়াড়,, যার সমকক্ষ এখও জন্মায়নি। ইরান তার স্বার্থসিদ্ধির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে তার পক্সি তৈরি করেছে যার প্রমান বিশ্ব আগেই দেখেছে। কাসেম সোলাইমানীর মৃত্যুর পর ইরান তার নীতি ঢেলে সাজিয়েছে। তাতে ফিলিস্তিনের হামাস, ইসলামী জিহাদ, হিজবুল্লাহ, হুতি কে নিয়ে প্রতিরোধের অক্ষ শক্তি তৈরি করাটা একক ভাবে সোলাইমানীর কৃতিত্ব।
পুতিনের মত লোক কে সিরিয়াতে আনা সোজা কথা নয়, সেই অসাধ্য কাজটি সাধন করেছেন বলেই তাকে তার মূল্য জীবন দিয়ে দিতে হয়। অনেকে বলেন সোলাইমানী বেচে থাকলে পুতিন কে ইয়েমেন এ টেনে আনতেন।
হিজবুল্লাহ, হামাস আর ইসলামি জিহাদ যে পলিসিতে ইসরাঈলে হামলা করে তার পলিসি ইরান হতে আমদানী করা।
ইসরাঈলের ক্ষতির পরিমান ২০০৬, ২০১৪ এবং ২০১৯ এর থেকে এবার অনেক বেশি হয়েছে ইরানী সামরিক পরামর্শের জন্য। এমনিতে ফিলিস্তিনের সাথে ঝামেলা হলে তা দুই তিন দিন পর্যন্ত গড়ায়, কিন্তু এবার দশ দিনের বেশি হওয়ার কারনটা অন্য রকম। কারণ ইরান একটা ইস্যু খুঁজছিলো আনবিক চুক্তির দরকষাকষির জন্য আর ফিলিস্তিনের এই ইস্যু কে সে ব্যবহার করেছে ঠিক জায়গাতে।
হামাস যতটা না বেশি সক্রিয় ছিল, তার চেয়ে ইসলামী জিহাদ বেশি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এমন কি রকেট ছাড়াও মিসাইল ছুড়েছে, আবার সাবমেরিন দিয়েও আঘাত হানার চেষ্টা করেছে। কেননা ফিলিস্তিনের এই সংগঠনই ইরানের আনুগত্য করে চলে।
আর নেতিয়ানিয়াহু তার ইমেজ বাড়াতে গিয়ে ইরানের ফাদে পা দিলেন যার কোন ফলাফল তার পক্ষে যাইনি বরং ইরানের প্রভাব আরো বেড়েছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্টও তার সালতানাত কায়েমের জন্য এ যুদ্ধে শরিক হয়েছেন। কারন গোটা অঞ্চল একসময় তার অধীনে ছিল। তুরস্কই বিশ্বের একমাত্র মুসলিম দেশ যে কিনা এই অবৈধ রাষ্ট্রকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে, আবার বিবাদেও জড়িয়েছে।
তুরস্ক এখন নিজেকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়োজিত করেছে এজন্য যে, লুজান চুক্তির শত বছর পূর্ণ হতে চলেছে। আর তুরস্ক চায় এই লুজান চুক্তিটি কোন ঝামেলা ছাড়াই পুনর্বিবেচনা করে এর পরিসমাপ্তি ঘটাতে। তাছাড়া ফিলিস্তিনের জন্য আলাদা বাহিনী গঠন করার দাবি তোলা যতটানা বাস্তবিক তার চেয়ে তুরস্কের নিজেকে জাহির করাটা তার মুখ্য উদ্দেশ্য। কেননা এরদোয়ান বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরিকভাবে কোনঠাসা।
চীন এই প্রথম ফিলিস্তিন ইস্যুতে এত বড় আকারে তার প্রতিক্রিয়া দেখালো। এর মাঝেও তাদের ভূরাজনীতি অন্তর্নিহিত। যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনাধীন জিংজিয়ান প্রদেশের বন্দি শিবিরের অন্যায়টাকে চীন ধামাচাপা দিতে চাইছে। আর আগের যে কোন ইস্যুতে নিরব থাকা পলিসি ভেঙ্গে এখন বিশ্ব রাজনীতির অপরিহার্য হওয়ার বার্তা দিতে চাইছে। কেননা ফিলিস্তিন ইস্যুতে এর আগে এতো ঘটা করে প্রতিক্রিয়া চীন কখনই দেখাইনি।
তাছাড়া তুরস্ক এবং ইরানেরও হাত আছে এ ব্যাপারে এবং চীন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গ্রুপের সাথে মিশেতে চাইছে। ইতমধ্যে চীন তালেবান ইস্যুতে একটি পক্ষ অবলম্বন করেছে। যদিও ইসরাইলের সাথে তার গভীর সম্পর্ক, তথাপিও সে রাজনীতির খেলায় এ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। আর ২০২১ সালের এই ইসরাঈল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ তার জন্য মক্ষম সময় হয়ে উঠেছে।
তবে সোলাইমানী বেঁচে থাকলে পরিস্তিতি আরো ব্যপক হারে পাল্টে যেত।
ছন্নছাড়া ইসরাঈল
এতো বাগাড়ম্বর করেও যুদ্ধের প্রচারে ইসরাঈলের কোন লাভ হয়নি বরং তার বিরুদ্ধে দুনিয়ার সচেতন মানুষ পূর্বাপেক্ষা আরো বেশি ফুসে উঠেছে।
ইসরাঈল কে এবার চার-পাচ ফ্রন্টে লড়তে হচ্ছে, এর মাঝে হিজবুল্লাহ রকেট ছুড়েছে, সিরিয়া হতে মিসাঈল, জর্ডান হতে ড্রোন হামলা, হামাস-ইসলামী জিহাদের সাথে যোগ হয়েছে নিজ দেশের জনগনের বিক্ষোভ। আগে সাধারনত দেখা যেত হামাস ও ইসলামী জিহাদের সাথে লড়াই হতো।
পাঠক এখানে একটি বিষয় গভীরভাবে লক্ষ্যনীয় এ ব্যাপারটি বুঝতে পারলে উপরের সমস্ত ঘটনা জলের মতো পরিস্কার। যুদ্ধ বাধল ফিলিস্তিনের সাথে। লেবাননের হিজবুল্লাহর সাথে না, সিরিয়ার সাথেও না, আবার জর্ডানের সাথে তো কোন ভাবেই না। তবে কেন হিজবুল্লাহ রকেট ছুড়লো, সিরিয়া হতে মিসাঈল আসলো, জর্ডান হতে ড্রোন?
এসবই ইরানের কারসাজি। উদ্দেশ্য ইসরাঈলকে ব্যতিব্যস্ত রাখা যাতে আনবিক চুক্তির ব্যাপারে সে নাক গলাতে না পারে।
কারন ইসরাঈলী গোয়েন্দা প্রধান মাত্র কয়েক দিক আগে বাইডেনের সাথে দেখা করতে গেছেন। ইরান শুধু এতটুকু করেই ক্ষান্ত হইনি। এতদিন ইসরাঈল ইরানে অভ্যন্তরিন আঘাত চালাতো এবারে তার উল্টো ব্যাপারটি ঘটলো। হামাস কে দিয়ে আরব ইসরাঈলীদের কে ক্ষেপিয়ে তুলে ইসরাঈলকে ছন্নছাড়া করেছে ইরান।
আরো বিস্তারিত পরের কিসতিতে…