ঢাকা ০৩:১৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞপ্তি :
সারাদেশের জেলা উপোজেলা পর্যায়ে দৈনিক স্বতঃকণ্ঠে সংবাদকর্মী নিয়োগ চলছে । আগ্রহী প্রার্থীগন জীবন বৃত্তান্ত ইমেইল করুন shatakantha.info@gmail.com // দৈনিক স্বতঃকণ্ঠ অনলাইন ও প্রিন্ট পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন ০১৭১১-৩৩৩৮১১, ০১৭৪৪-১২৪৮১৪

আগষ্টের দুঃসহ স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায়

বার্তাকক্ষ
  • প্রকাশিত সময় ০৩:৩০:৪৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ অগাস্ট ২০২১
  • / 124

বাঙালীর শোকাবহ দিন ১৫ আগষ্ট। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ বিধস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন উন্নয়নের মহাযজ্ঞ নিয়ে বিভোর সে সময় পাকপন্থি আন্তর্জাতিক চক্র হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে ইতিহাসের চাকাকে উল্টো পথে ঘুরানোর প্রচেষ্টা চালায়।

বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে হত্যার শিকার হন তখন আমি জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যার মর্মন্তুদ ঘটনার পরে সারা দেশে লাখো আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীর উপর ভয়াবহ নির্যাতন ও নিপিড়ন চালানো হয়। বঙ্গুবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে সংগঠিত করার চেষ্টার অভিযোগে একটি বিশেষ বাহিনী আমাকেও গ্রেফতার করে। নির্জন সেলে আড়াই মাস ধরে চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন। যা আজও ঘুমের ঘোরে শিউরে উঠি।

ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে আড়াই বছরের বন্দি জীবন ও ভয়াবহ নির্যাতনের দগদগে স্মৃতি প্রতি বছর আগষ্ট এলেই তা মনে ঝড় তোলে। সেসব ভয়াবহ দিনের স্মৃতি নিয়ে তাই লিখার প্রচেষ্টা।

১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন তখন খাদ্য নেই, বাসস্থান নেই, বিদ্যুৎ নেই। রাস্তাঘাটসহ সকল অবকাঠামো ধংসপ্রায়। রিজার্ভ ব্যাংকও শুণ্য।

১৯৭২ সালে শেখ মুজিব সরকার মাত্র এক বছরের মধ্যে দেশ পুনর্গঠনে প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন, সংবিধান প্রনয়ণ, এক কোটি মানুষের পুনর্বাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন, ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ ৪০হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ, দুঃস্থ মহিলাদের কল্যাণে নারী পুনর্বাসন সংস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ, পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও চালু করার মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারীর কর্মসংস্থান, ঘোড়াশাল সার কারখানা, আশুগঞ্জ সার কারখানা কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপন, বন্ধ শিল্প-কারখানা চালুকরার কর্মসুচি গ্রহণ করা হয়। মদ তৈরি ও বিপণন এবং জুয়া নিষিদ্ধ করা হয়।

অল্প সময়ে প্রায় সব রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় ও জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের এক বড় সাফল্য।

কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে নানা ভুমিকা গ্রহণ, ১০০ বিঘার অতিরিক্ত জমির মালিকদের জমি ও চরের জমি বিনামূল্যে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টন করা। গ্রামবাংলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ও শিল্প-কৃষি উৎপাদনের জন্য পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ণ বোর্ডের প্রতিষ্ঠা, বঙ্গবন্ধু সরকার স্থানীয় সরকারের গণতন্ত্রায়নের সূচনা করেন।

ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভায় গণভোটে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৭৩ সালের ফেব্রয়ারি পর্যন্ত ১০ কোটি টাকা কৃষি ঋণ, ৫ কোটি টাকার সমবায় ঋণ বন্টন করা হয়। ১০ লাখ বসতবাড়ি নির্মাণ, ৩০ কোটি টাকার রিলিফ বিতরণ করা হয়।

শেখ মুজিবের নির্দেশে ১৯৭৫ সালে ২১ জুন সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করে পুর্বের ১৯টি জেলার স্থলে ৬১টি জেলা সৃষ্টি করা হয়।

তবে বঙ্গবন্ধুর সরচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে মিত্রবাহিনীর সৈন্য ভারতে প্রত্যাবর্তন। তিনি ২ ফেব্রয়ারি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করানোয় পৃথিবীর ইউতহাসে এক বিরল ঘটনার জন্ম দেন। কারণ কোন মিত্র সৈন্যই কোন দেশ থেকে এত অল্প সময়ে প্রত্যাহারের কোন ইতিহাস নেই।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহুর্তে বাংলাদেশে ঘাপটি মেড়ে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী কিছু স্বার্থলোভী, উচ্চাভিলাসী বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র নামধারীরা গণবাহিনী গঠন করে। এরা দেশের মধ্যে খুন, রাহাজানি, ডাকাতি, লুটতরাজ করে উন্নয়নের ধারাকে করে বাধাগ্রস্থ।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পাবনা জেলা শাখার সম্মেলনে আমি জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক দুদক কমিশনার বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু সভাপতি নির্বাচিত হয়।

পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে আমি সাধারন সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পু সভাপতি নির্বাচিত হন।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা দেশ গঠনে অংশ গ্রহণ করি। ঠিক সেই মুহুর্তে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দেখা দেয় এক ভয়াবহ বন্যা। সেই বন্যায় দেশের বেশির ভাগ জেলা কবলিত হয় এবং সামুদ্রিক এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় হাজার হাজার মানুষ প্লাবিত ও গৃহবন্দী হয়।

একদিকে উন্নয়নের ধারাকে অব্যহত রাখা অন্যদিকে বন্যার্ত মানুষের উদ্ধার ও সহায়তা নিয়ে যখন শেখ মুজিব রাতদিন মগ্ন সে সুযোগ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশের বন্যার্ত মানুষের সাহায্যের প্রতিশ্রুতির নামে ত্রাণ সামগ্রী পাঠিয়ে বঙ্গোপসাগরে জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। তারা দেশের মধ্যে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করতে তৎপর হয়।

আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা দু:স্থ মানুষের পাশে না দাড়িয়ে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করে।

আমি সে সময় পাবনা জেলা শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহ. শাহাবুদ্দিন চুপ্পু ও পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শহীদ এম মনসুর আলীর সুযোগ্য সন্তান মরহুম মোহাম্মদ নাসিমের নেতৃত্বে একদিকে জেলার নিম্ন অঞ্চলের বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো অন্যদিকে পাবনার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের হত্যা-গুম লুটতরাজ থেকে রক্ষা করা। অন্যদিকে পাবনার নিম্নাঞ্চলের মানুষদেরকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করার কাজে আত্মনিয়োগ করি। আর আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা ঈর্ষান্বিত হয়ে জাতির পিতার সকল কর্মসুচি বাধাগ্রস্থ করতে লিপ্ত ছিল।

কিন্তু দেশের মধ্যে দুর্ভিক্ষ ও বিভিন্ন ষড়যন্ত্র কারীরাসহ স্বাধীনতা বিরোধী চক্র তাদের নীল নকশা অনুযায়ী ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট রাতের অন্ধকারে জাতির পিতাসহ তার পরিবারের সকল সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

সেদিন তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হননি। তারা সামরিক শাসনের নামে আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের কর্মীদের নিধনে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল গুম, হত্যা, গৃহবন্দি এবং অনেকেই জীবন বাচাতে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়। এই নির্যাতন ও অত্যাচার থেকে আমিও রক্ষা পাইনি।

১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট শহীদ এম. মনসুর আলীর সহধর্মীনি মরহুম আমেনা মনসুর মহিলা সমিতির সভায় যোগ দেওয়ার লক্ষে পাবনায় আসেন। এদিকে বন্যার ত্রাণ ও অন্যদিকে সন্ত্রাসীদের হিংসাতক কার্যাবলি প্রতিহত করাসহ শ্রদ্ধাভাজন চাচী আমেনা মনসুরকে নিরপত্তা দেওয়ার কাজে আমরা ব্যস্ত থাকি । অনুষ্ঠান শেষে চাচীকে শহরের কালাচাঁদ পাড়ায় তার বাসায় রেখে কাজ শেষ করে গভীর রাতে বাসায় ফিরে আসি।
আমার বাবা ১৫ আগস্ট ভোরে রেডিওতে শুনতে পান বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সবাইকে কিছু বিপদগামী সেনা হত্যা করেছে। তাৎক্ষণিক আমায় ঘুম থেকে থেকে ডেকে তুলে এ দু:সংবাদটি জানানো হয়। আমি হতম্বভ। তাৎক্ষণিক এম মনসুর আলীর কালাচাঁদ পাড়া বাসায় গিয়ে দেখি জেলা আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতা আমেনা মনসুর চাচীর সঙ্গে অবস্থান করছেন।

অন্যদিকে জেলা আওয়ামীলীগের বেশ কিছু নেতাকর্মী স্বাধীনতা বিরোধীদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষায় পাবনা টাউন হল, ইন্দিরা মোড়সহ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নেয়।
আমরা শোকে স্তব্ধ চাচীকে ঘিরে বসে থাকাকালে শহীদ এম. এনসুর আলী তিন বার টেলিফোন করেন।

প্রথমে তিনি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করার কথা জানিয়ে বলেন তোমরা পাবনায় অবস্থান করবে এবং শহরকে স্বাধীনতা বিরোধী, গণবাহিনী ও সন্ত্রাসীরা যেন প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে সর্তক থাকবে।

দ্বিতীয়বার ফোনে এম মনসুর আলী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করার কথা জানান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকরীদের দমনে সেনাবাহিনী, রক্ষীবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশ বাহিনীর সাথে তিনি যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করছেন।

যখন সকল সশস্ত্রবাহিনী আত্মসমর্পণ করে তখন তিনি তৃতীয়বার ফোন দিয়ে বলেন, তোমরা সবাই তোমাদের চাচীকে নিরাপদ স্থানে রেখে যার যার মতো নিরাপদ স্থানে চলে যাও।

আমরা তখন চাচী আমেনা মনসুরকে দ্বিপচরে এক শুভাকাঙ্খীর বাসায় রেখে যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাই। এরই মধ্যে যে সকল আওয়ামীলীগ নেতাকর্মী শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছিল তাদেরকে পুলিশ স্থান ত্যাগ করার জন্য আহবান জানায় অন্যথায় লাঠিচার্জের ঘোষণা দেয়। তখন তারা বাধ্য হয়ে স্থান ত্যাগ করেন।
আমি পাবনা শহরের কৃষ্ণপুর এস এম ইব্রাহিম বাবুর বাসায় আত্মগোপন করি। সেখান থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি।
এরপর বিভিন্নসুত্রে জানতে পারি সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মরহুম নাসিম ভাইসহ অন্য নেতাবৃন্দ ভারতের কলকাতায় অবস্থান করছেন। তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে সংঘবন্ধ হচ্ছেন। আমি তখনই কলকাতায় গিয়ে নসিম ভাইসহ অন্যান্য নেতাদের সাথে মিলিত হই।

কলকাতায় এক বেলা খেয়ে না খেয়ে ছয় মাস থাকার পর নেতাদের পরামর্শে দেশে ফিরে গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপন করি। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৭৬ সালের ১১ই আগস্ট সকাল ১০ টার দিকে তৎকালীন সামরিক গোয়িন্দাবাহিনীর হাতে ঢাকার নবাবপুরে বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা বাদশার অফিস থেকে গ্রেফতার হই।

গ্রেফতার হওয়ার পর আমাকে গোয়িন্দা বাহিনীর লোকেরা তৎকালীন গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে গাড়িতে তুলে। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের কাছে আসার পর আমাকে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। পরে চোখ খোলার পর জানতে পারি সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর নির্যাতন ও ইন্টারোগেশন সেলে আছি।

আমার গ্রেফতারের খবর পেয়ে বাবা ও ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজবাহুর রহমান রোজ পাবনা থেকে ঢাকা সেনানিবাসে যায় । সেখানে তাদেরকে কোন তথ্য না দিয়ে অপমান করে বিদায় করা হয়।

নির্জনসেলে আমাকে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। চোখ বেঁধে ঝুলন্ত অবস্থায় শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতসহ পুরুষাঙ্গে ইট বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে পশুর মতো আচরণ করা হয়। নির্জন সেলে আড়াই মাস আলো বাতাস ও দেখতে পারি নি।
এ আড়াই মাস আমার পরিবার পরিজন আমি জীবত না মৃত তা নিয়ে অন্ধকারে ছিলো। আর ওদের বর্বর নির্যাতনে নিজের কাছেই মনে হতো আমি কি বেঁচে আছি? শরীরের সংবেদনশীলতা যেন অসার হয়ে আসছিল। এভাবে চলার পর একদিন আমাকে চোখ বেঁধে মালিবাগ ডিএসবির প্রধান কার্যালয় হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়।

কেন্দ্রীয় কারাগারে সাবেক মন্ত্রী মরহুম আব্দুল আজিজ, মরহুম আব্দুল মোমিন তালুকদার, আওয়ামীলীগ নেতা আমির হোসেন আমু ভাই, মরহুম গাজী গোলাম মোস্তফা, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু ভাই, মায়া ভাই, পাহাড়ী ভাই, এসপি মাহাবুবসহ শতাধিক আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগের নেতৃবৃন্দের সংস্পর্শে আসি। তাদের সহযোগিতায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নিউ জেলে থাকার সৌভাগ্য হয়।

কেন্দ্রীয় কারাগারের যে সেলে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট জাতীয় নেতা শহীদ এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে যে কক্ষে আটক রাখা হয় সেখানে আমার থাকার সৌভাগ্য হয়।

কারাগারে এসে ফিরে পেলাম নতুন জীবন। জেলে থাকাকালীন আমিসহ নেতৃবৃন্দ জেলখানায় সামরিক সরকারের পাগলা ঘন্টির নির্যাতনও সইতে হয়। আড়াই বছর পরে আমি হাইর্কোটে রিটের মাধ্যেমে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে পাবনায় ফিরে আসি।

এরপর বিভিন্ন কারণে পাবনায় না থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যায়ের প্রথম বর্ষে ভর্তি হই। ১৯৭৫ সালে আমি অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীর্ক্ষাথী ছিলাম কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যা, দেশত্যাগ ও পলাতক থাকার কারণে পরীক্ষা দিতে পারিনি।
কিন্তু পারিবারিক ও আর্থিক সঙ্কটের কারণে বিদেশে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী কলকাতায় নিয়োজিত ডেপুটি হাইকমিশনার ও তৎকালীন গনপ্রজাতন্তী বাংলাদেশ সরকারের নিযুক্ত জার্মানের রাষ্ট্রদূত মরহুম এম হোসেন আলী ও নিজ ছোট ভাই রোজের সহযোগিতায় অস্ট্রিয়া যাই।

সেখানে আন্তর্জাতিক পারমানবিক শক্তি সংস্থায় ৩০ বছর কাজ করার পাশাপাশি আওয়ামীলীগ সংগঠন সংগঠিত করি। এরপর ২০১৪ সালে দেশে আসার পর পাবনা জেলা আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা হিসাবে এখনো কাজ করে যাচ্ছি।

৭৫ এর ১৫ আগস্টের ভয়ঙ্কর দু:স্বপ্নের স্মৃতি আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের কারণ হিসেবে আমার মনে হয়েছে অল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধ বিধস্ত দেশে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ আর বৈদেশিক কুটনৈতিক সাফল্যে আন্তর্জাতিকমহলে তিনি অবিসাংবাদিত নেতা হয়ে উঠেন। বঙ্গবন্ধুর কারিশমায় বিশ্বনেতৃত্ব দেয়ার আতঙ্ক সৃষ্টি করে কোন কোন বৈদেশিক শক্তিকে। তারাই পাকপন্থিদের কাজে লাগিয়ে এ ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় তৈরি করে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে। আমি শোকাবহ ১৫ আগস্টের নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.স.ম আব্দুর রহিম পাকন
বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.স.ম আব্দুর রহিম পাকন
উপদেষ্টা, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ পাবনা জেলা শাখা ও নির্বাহী সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ’৭১ এবং সভাপতি বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন পাবনা জেলা শাখা, সাবেক কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা, প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (১৯৭৩-৭৫) ।

এই রকম আরও টপিক

আগষ্টের দুঃসহ স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায়

প্রকাশিত সময় ০৩:৩০:৪৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ অগাস্ট ২০২১

বাঙালীর শোকাবহ দিন ১৫ আগষ্ট। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ বিধস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন উন্নয়নের মহাযজ্ঞ নিয়ে বিভোর সে সময় পাকপন্থি আন্তর্জাতিক চক্র হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে ইতিহাসের চাকাকে উল্টো পথে ঘুরানোর প্রচেষ্টা চালায়।

বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে হত্যার শিকার হন তখন আমি জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যার মর্মন্তুদ ঘটনার পরে সারা দেশে লাখো আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীর উপর ভয়াবহ নির্যাতন ও নিপিড়ন চালানো হয়। বঙ্গুবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে সংগঠিত করার চেষ্টার অভিযোগে একটি বিশেষ বাহিনী আমাকেও গ্রেফতার করে। নির্জন সেলে আড়াই মাস ধরে চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন। যা আজও ঘুমের ঘোরে শিউরে উঠি।

ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে আড়াই বছরের বন্দি জীবন ও ভয়াবহ নির্যাতনের দগদগে স্মৃতি প্রতি বছর আগষ্ট এলেই তা মনে ঝড় তোলে। সেসব ভয়াবহ দিনের স্মৃতি নিয়ে তাই লিখার প্রচেষ্টা।

১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন তখন খাদ্য নেই, বাসস্থান নেই, বিদ্যুৎ নেই। রাস্তাঘাটসহ সকল অবকাঠামো ধংসপ্রায়। রিজার্ভ ব্যাংকও শুণ্য।

১৯৭২ সালে শেখ মুজিব সরকার মাত্র এক বছরের মধ্যে দেশ পুনর্গঠনে প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন, সংবিধান প্রনয়ণ, এক কোটি মানুষের পুনর্বাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন, ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ ৪০হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ, দুঃস্থ মহিলাদের কল্যাণে নারী পুনর্বাসন সংস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ, পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও চালু করার মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারীর কর্মসংস্থান, ঘোড়াশাল সার কারখানা, আশুগঞ্জ সার কারখানা কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপন, বন্ধ শিল্প-কারখানা চালুকরার কর্মসুচি গ্রহণ করা হয়। মদ তৈরি ও বিপণন এবং জুয়া নিষিদ্ধ করা হয়।

অল্প সময়ে প্রায় সব রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় ও জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের এক বড় সাফল্য।

কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে নানা ভুমিকা গ্রহণ, ১০০ বিঘার অতিরিক্ত জমির মালিকদের জমি ও চরের জমি বিনামূল্যে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টন করা। গ্রামবাংলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ও শিল্প-কৃষি উৎপাদনের জন্য পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ণ বোর্ডের প্রতিষ্ঠা, বঙ্গবন্ধু সরকার স্থানীয় সরকারের গণতন্ত্রায়নের সূচনা করেন।

ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভায় গণভোটে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৭৩ সালের ফেব্রয়ারি পর্যন্ত ১০ কোটি টাকা কৃষি ঋণ, ৫ কোটি টাকার সমবায় ঋণ বন্টন করা হয়। ১০ লাখ বসতবাড়ি নির্মাণ, ৩০ কোটি টাকার রিলিফ বিতরণ করা হয়।

শেখ মুজিবের নির্দেশে ১৯৭৫ সালে ২১ জুন সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করে পুর্বের ১৯টি জেলার স্থলে ৬১টি জেলা সৃষ্টি করা হয়।

তবে বঙ্গবন্ধুর সরচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে মিত্রবাহিনীর সৈন্য ভারতে প্রত্যাবর্তন। তিনি ২ ফেব্রয়ারি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করানোয় পৃথিবীর ইউতহাসে এক বিরল ঘটনার জন্ম দেন। কারণ কোন মিত্র সৈন্যই কোন দেশ থেকে এত অল্প সময়ে প্রত্যাহারের কোন ইতিহাস নেই।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহুর্তে বাংলাদেশে ঘাপটি মেড়ে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী কিছু স্বার্থলোভী, উচ্চাভিলাসী বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র নামধারীরা গণবাহিনী গঠন করে। এরা দেশের মধ্যে খুন, রাহাজানি, ডাকাতি, লুটতরাজ করে উন্নয়নের ধারাকে করে বাধাগ্রস্থ।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পাবনা জেলা শাখার সম্মেলনে আমি জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক দুদক কমিশনার বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু সভাপতি নির্বাচিত হয়।

পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে আমি সাধারন সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পু সভাপতি নির্বাচিত হন।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা দেশ গঠনে অংশ গ্রহণ করি। ঠিক সেই মুহুর্তে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দেখা দেয় এক ভয়াবহ বন্যা। সেই বন্যায় দেশের বেশির ভাগ জেলা কবলিত হয় এবং সামুদ্রিক এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় হাজার হাজার মানুষ প্লাবিত ও গৃহবন্দী হয়।

একদিকে উন্নয়নের ধারাকে অব্যহত রাখা অন্যদিকে বন্যার্ত মানুষের উদ্ধার ও সহায়তা নিয়ে যখন শেখ মুজিব রাতদিন মগ্ন সে সুযোগ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশের বন্যার্ত মানুষের সাহায্যের প্রতিশ্রুতির নামে ত্রাণ সামগ্রী পাঠিয়ে বঙ্গোপসাগরে জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। তারা দেশের মধ্যে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করতে তৎপর হয়।

আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা দু:স্থ মানুষের পাশে না দাড়িয়ে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করে।

আমি সে সময় পাবনা জেলা শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহ. শাহাবুদ্দিন চুপ্পু ও পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শহীদ এম মনসুর আলীর সুযোগ্য সন্তান মরহুম মোহাম্মদ নাসিমের নেতৃত্বে একদিকে জেলার নিম্ন অঞ্চলের বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো অন্যদিকে পাবনার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের হত্যা-গুম লুটতরাজ থেকে রক্ষা করা। অন্যদিকে পাবনার নিম্নাঞ্চলের মানুষদেরকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করার কাজে আত্মনিয়োগ করি। আর আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা ঈর্ষান্বিত হয়ে জাতির পিতার সকল কর্মসুচি বাধাগ্রস্থ করতে লিপ্ত ছিল।

কিন্তু দেশের মধ্যে দুর্ভিক্ষ ও বিভিন্ন ষড়যন্ত্র কারীরাসহ স্বাধীনতা বিরোধী চক্র তাদের নীল নকশা অনুযায়ী ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট রাতের অন্ধকারে জাতির পিতাসহ তার পরিবারের সকল সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

সেদিন তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হননি। তারা সামরিক শাসনের নামে আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের কর্মীদের নিধনে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল গুম, হত্যা, গৃহবন্দি এবং অনেকেই জীবন বাচাতে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়। এই নির্যাতন ও অত্যাচার থেকে আমিও রক্ষা পাইনি।

১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট শহীদ এম. মনসুর আলীর সহধর্মীনি মরহুম আমেনা মনসুর মহিলা সমিতির সভায় যোগ দেওয়ার লক্ষে পাবনায় আসেন। এদিকে বন্যার ত্রাণ ও অন্যদিকে সন্ত্রাসীদের হিংসাতক কার্যাবলি প্রতিহত করাসহ শ্রদ্ধাভাজন চাচী আমেনা মনসুরকে নিরপত্তা দেওয়ার কাজে আমরা ব্যস্ত থাকি । অনুষ্ঠান শেষে চাচীকে শহরের কালাচাঁদ পাড়ায় তার বাসায় রেখে কাজ শেষ করে গভীর রাতে বাসায় ফিরে আসি।
আমার বাবা ১৫ আগস্ট ভোরে রেডিওতে শুনতে পান বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সবাইকে কিছু বিপদগামী সেনা হত্যা করেছে। তাৎক্ষণিক আমায় ঘুম থেকে থেকে ডেকে তুলে এ দু:সংবাদটি জানানো হয়। আমি হতম্বভ। তাৎক্ষণিক এম মনসুর আলীর কালাচাঁদ পাড়া বাসায় গিয়ে দেখি জেলা আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতা আমেনা মনসুর চাচীর সঙ্গে অবস্থান করছেন।

অন্যদিকে জেলা আওয়ামীলীগের বেশ কিছু নেতাকর্মী স্বাধীনতা বিরোধীদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষায় পাবনা টাউন হল, ইন্দিরা মোড়সহ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নেয়।
আমরা শোকে স্তব্ধ চাচীকে ঘিরে বসে থাকাকালে শহীদ এম. এনসুর আলী তিন বার টেলিফোন করেন।

প্রথমে তিনি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করার কথা জানিয়ে বলেন তোমরা পাবনায় অবস্থান করবে এবং শহরকে স্বাধীনতা বিরোধী, গণবাহিনী ও সন্ত্রাসীরা যেন প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে সর্তক থাকবে।

দ্বিতীয়বার ফোনে এম মনসুর আলী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করার কথা জানান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকরীদের দমনে সেনাবাহিনী, রক্ষীবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশ বাহিনীর সাথে তিনি যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করছেন।

যখন সকল সশস্ত্রবাহিনী আত্মসমর্পণ করে তখন তিনি তৃতীয়বার ফোন দিয়ে বলেন, তোমরা সবাই তোমাদের চাচীকে নিরাপদ স্থানে রেখে যার যার মতো নিরাপদ স্থানে চলে যাও।

আমরা তখন চাচী আমেনা মনসুরকে দ্বিপচরে এক শুভাকাঙ্খীর বাসায় রেখে যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাই। এরই মধ্যে যে সকল আওয়ামীলীগ নেতাকর্মী শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছিল তাদেরকে পুলিশ স্থান ত্যাগ করার জন্য আহবান জানায় অন্যথায় লাঠিচার্জের ঘোষণা দেয়। তখন তারা বাধ্য হয়ে স্থান ত্যাগ করেন।
আমি পাবনা শহরের কৃষ্ণপুর এস এম ইব্রাহিম বাবুর বাসায় আত্মগোপন করি। সেখান থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি।
এরপর বিভিন্নসুত্রে জানতে পারি সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মরহুম নাসিম ভাইসহ অন্য নেতাবৃন্দ ভারতের কলকাতায় অবস্থান করছেন। তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে সংঘবন্ধ হচ্ছেন। আমি তখনই কলকাতায় গিয়ে নসিম ভাইসহ অন্যান্য নেতাদের সাথে মিলিত হই।

কলকাতায় এক বেলা খেয়ে না খেয়ে ছয় মাস থাকার পর নেতাদের পরামর্শে দেশে ফিরে গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপন করি। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৭৬ সালের ১১ই আগস্ট সকাল ১০ টার দিকে তৎকালীন সামরিক গোয়িন্দাবাহিনীর হাতে ঢাকার নবাবপুরে বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা বাদশার অফিস থেকে গ্রেফতার হই।

গ্রেফতার হওয়ার পর আমাকে গোয়িন্দা বাহিনীর লোকেরা তৎকালীন গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে গাড়িতে তুলে। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের কাছে আসার পর আমাকে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। পরে চোখ খোলার পর জানতে পারি সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর নির্যাতন ও ইন্টারোগেশন সেলে আছি।

আমার গ্রেফতারের খবর পেয়ে বাবা ও ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজবাহুর রহমান রোজ পাবনা থেকে ঢাকা সেনানিবাসে যায় । সেখানে তাদেরকে কোন তথ্য না দিয়ে অপমান করে বিদায় করা হয়।

নির্জনসেলে আমাকে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। চোখ বেঁধে ঝুলন্ত অবস্থায় শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতসহ পুরুষাঙ্গে ইট বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে পশুর মতো আচরণ করা হয়। নির্জন সেলে আড়াই মাস আলো বাতাস ও দেখতে পারি নি।
এ আড়াই মাস আমার পরিবার পরিজন আমি জীবত না মৃত তা নিয়ে অন্ধকারে ছিলো। আর ওদের বর্বর নির্যাতনে নিজের কাছেই মনে হতো আমি কি বেঁচে আছি? শরীরের সংবেদনশীলতা যেন অসার হয়ে আসছিল। এভাবে চলার পর একদিন আমাকে চোখ বেঁধে মালিবাগ ডিএসবির প্রধান কার্যালয় হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়।

কেন্দ্রীয় কারাগারে সাবেক মন্ত্রী মরহুম আব্দুল আজিজ, মরহুম আব্দুল মোমিন তালুকদার, আওয়ামীলীগ নেতা আমির হোসেন আমু ভাই, মরহুম গাজী গোলাম মোস্তফা, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু ভাই, মায়া ভাই, পাহাড়ী ভাই, এসপি মাহাবুবসহ শতাধিক আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগের নেতৃবৃন্দের সংস্পর্শে আসি। তাদের সহযোগিতায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নিউ জেলে থাকার সৌভাগ্য হয়।

কেন্দ্রীয় কারাগারের যে সেলে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট জাতীয় নেতা শহীদ এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে যে কক্ষে আটক রাখা হয় সেখানে আমার থাকার সৌভাগ্য হয়।

কারাগারে এসে ফিরে পেলাম নতুন জীবন। জেলে থাকাকালীন আমিসহ নেতৃবৃন্দ জেলখানায় সামরিক সরকারের পাগলা ঘন্টির নির্যাতনও সইতে হয়। আড়াই বছর পরে আমি হাইর্কোটে রিটের মাধ্যেমে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে পাবনায় ফিরে আসি।

এরপর বিভিন্ন কারণে পাবনায় না থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যায়ের প্রথম বর্ষে ভর্তি হই। ১৯৭৫ সালে আমি অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীর্ক্ষাথী ছিলাম কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যা, দেশত্যাগ ও পলাতক থাকার কারণে পরীক্ষা দিতে পারিনি।
কিন্তু পারিবারিক ও আর্থিক সঙ্কটের কারণে বিদেশে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী কলকাতায় নিয়োজিত ডেপুটি হাইকমিশনার ও তৎকালীন গনপ্রজাতন্তী বাংলাদেশ সরকারের নিযুক্ত জার্মানের রাষ্ট্রদূত মরহুম এম হোসেন আলী ও নিজ ছোট ভাই রোজের সহযোগিতায় অস্ট্রিয়া যাই।

সেখানে আন্তর্জাতিক পারমানবিক শক্তি সংস্থায় ৩০ বছর কাজ করার পাশাপাশি আওয়ামীলীগ সংগঠন সংগঠিত করি। এরপর ২০১৪ সালে দেশে আসার পর পাবনা জেলা আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা হিসাবে এখনো কাজ করে যাচ্ছি।

৭৫ এর ১৫ আগস্টের ভয়ঙ্কর দু:স্বপ্নের স্মৃতি আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের কারণ হিসেবে আমার মনে হয়েছে অল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধ বিধস্ত দেশে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ আর বৈদেশিক কুটনৈতিক সাফল্যে আন্তর্জাতিকমহলে তিনি অবিসাংবাদিত নেতা হয়ে উঠেন। বঙ্গবন্ধুর কারিশমায় বিশ্বনেতৃত্ব দেয়ার আতঙ্ক সৃষ্টি করে কোন কোন বৈদেশিক শক্তিকে। তারাই পাকপন্থিদের কাজে লাগিয়ে এ ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় তৈরি করে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে। আমি শোকাবহ ১৫ আগস্টের নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.স.ম আব্দুর রহিম পাকন
বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.স.ম আব্দুর রহিম পাকন
উপদেষ্টা, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ পাবনা জেলা শাখা ও নির্বাহী সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ’৭১ এবং সভাপতি বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন পাবনা জেলা শাখা, সাবেক কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা, প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (১৯৭৩-৭৫) ।