ঈশ্বরদী অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি নিরুপায় রোগীরা
- প্রকাশিত সময় ১২:৩১:৪১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৭ নভেম্বর ২০২১
- / 194
নিজেস্ব প্রতিনিধিঃ জরুরি মুহূর্তে রোগী আনা কিংবা মৃত রোগীকে নেওয়ার জন্য ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যাম্বুলেন্স খুঁজতে গিয়ে বিপাকে পড়েন রোগীর আত্মীয়-স্বজন।
ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সরকারি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে মাত্র একটি। অন্যদিকে বেসরকারি পর্যায়ে অনেক অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও সেখানে বিপত্তির নাম ‘সিন্ডিকেট’। জরুরি মুহূর্তে ইচ্ছে মতো ভাড়া হাঁকা থেকে শুরু নানা অনিয়মের অভিযোগ এই অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, সুযোগ পেলে রোগী ও মৃত ব্যক্তির স্বজনদের রীতিমতো জিম্মি করেন এসব অ্যাম্বুলেন্সের চালকরা। অন্যদিকে সবকিছু জেনেও উল্লেখযোগ্য কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় অভিযোগের তীর উঠেছে ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তা ব্যক্তিদের দিকে।
জানা যায়, ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সরকারী অ্যাম্বুলেন্স আছে মাত্র একটি, সেটিরও লক্কর ঝক্কর অবস্থা। ইশ্বরদী উপজেলায় রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ও ইপিজেড মিলে প্রায় ‘চার হাজার বিদেশী সহ প্রায় চল্লিশ হাজার শ্রমিক ও ৪ লক্ষ স্থায়ী মানুষ বসবাস করে এবং অস্থায়ী বাসিন্দা প্রায় এক লক্ষ। এত বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য ৫০ শয্য বিশিষ্ট হাসপাতাল ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। আর এর রোগী পরিবহনের জন্য রয়েছে একটি মাত্র সরকারী অ্যাম্বুলেন্স, যা হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় না থাকার মতই।
অন্যদিকে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সংকটের সুযোগ নেয় হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষায় থাকা বেসরকারি এই সব অ্যাম্বুলেন্স গুলো। এসব অ্যাম্বুলেন্সকে ঘিরে ঈশ্বরদী হাসপাতালে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
রোগীর স্বজনদের এ ব্যাপারে অভিযোগ অনেকদিনের হলেও এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তৃপক্ষ। তাই প্রশ্ন উঠেছে হাসপাতাল প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও।
অতিসম্প্রতি সাঁড়া মাড়োয়ারি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেনীর ছাত্রের অক্সিজেন কনসেনটেটর আবিষ্কার করে আলোচনায় আসা তাহের মাহমুদ তারিফ জানান, আমার বাবাও এই অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে মারা যান বলে অভিযোগ করেন।
তিনি জানান, ২০২০ সালে ২ আগষ্ট আমার বাবা মারা যান। ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ খাজা ইউনুস আলী মেডিকেলে ছয় হাজার দুইশত টাকা ভাড়া দিয়ে বাবাকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে জানি, ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জের ভাড়া তিন হাজার পাচশত টাকার মতো। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে নিয়ে যেয়েও আমার বাবা অক্সিজেনের অভাবে মারা যান।
কয়েক মাস আগে ঈশ্বরদী হাসপাতাল অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের কাছে হয়রানি স্বীকার হওয়া আরও এক ভুক্তভোগী জানান, ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে জরুরী যাওয়ার জন্য ভাড়া দাবি করে ৩ হাজার ২শ টাকা, এই টাকায় তিনি যেতে না চাইলে, অপর আরেক চালক তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে যায় এবং সে ২ হাজার ৭শ টাকায় যেতে প্রস্তাব দেয়, পরে আরও একটু খোঁজাখুঁজি করে আরেক জন চালক ২ হাজার ২শ টাকায় যেতে রাজি হয়, পড়ে আর খোঁজাঁখুজি না করে ২ হাজার ২শ টাকা চুক্তিতে ওই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালের পথে রওনা দেন তিনি। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারী হিসেবে নির্ধারিত অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া ১৪ শ টাকা।
দৈনিক স্বতঃকণ্ঠ‘র এই প্রতিবেদককে উদ্দেশ্য করে ভুক্তভোগী বলেন, একই দূরত্বে দুটি অ্যাম্বুলেন্স কীভাবে দুইরকম ভাড়া দাবি করে, বলুন? আবার যেতে না চাইলে অশোভন আচরণও করে। এদের এসব স্বেচ্ছাচারিতা আর কতদিন চলবে প্রশ্ন তোলেন ঐ ভুক্তভোগী।
এ বিষয়ে একজন অ্যাম্বুলেন্স চালকের সঙ্গে কথা বললে তিনি পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানান, ঈশ্বরদী হাসপাতালে প্রায় বেসরকারি ২২ টির মতো অ্যাম্বুলেন্স আছে, এখানে বিভিন্ন ক্যাটাগরির অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে, ক্যাটাগরি অনুযায়ী ভাড়া চাওয়া হয়।
তিনি আরোও জানান, ঈশ্বরদী হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতি নামে একটি সংগঠনও রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঈশ্বরদীর সচেতন মহলের একজন এ প্রতিবেদককে জানান, এই অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের নৈপথ্যে রয়েছেন সরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালক আলমগীর। সেবা নিয়ে নৈরাজ্য বন্ধ করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে এবং কিলোমিটার প্রতি নির্দিষ্ট ভাড়ার একটি থাকা উচিৎ বলে তিনি মনে করেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, এই এম্বুলেন্স ড্রাইভারদের মধ্যে অনেকে প্রতিনিয়ত মাদক সেবন, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপকর্ম করে চলছে এই হাসপাতালের ভেতরে। হাসপাতালের ভেতরে দেখা যায় ফেনসিডিলের খালি বোতল পড়ে আছে। এই ফেনসিডিলের বোতল গুলো কোথা থেকে আসে? সম্প্রতি র্যাব এর হাতে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার বিশাল অংকের মাদকের চালান সহ আটক হয়।
এরকম অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছেন এই সিন্ডিকেটের অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার গুলো।
ভেতরে গিয়ে দেখলে মনে হয় এটা হাসপাতাল না মাদকের আস্তানা এবং গাড়ি পার্কিং এর স্থান। তাই হাসপাতালের সেবা গ্রহণকারী রোগী সকল সিন্ডিকেটের লোকজনকে ভেতরে ঢুকতে না দেওয়ার জন্য প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
অপরদিকে, বেসরকারি এসব অ্যাম্বুলেন্সের কোন কোনটির ফিটনেস গ্রহণযোগ্য অবস্থায় নেই। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় এসব অ্যাম্বুলেন্সে রোগীর সিটের নিচে রাখা হয় গ্যাস সিলিন্ডার। এসব সিলিন্ডার নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না। ফলে এগুলো নিয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। আবার অনেক অ্যাম্বুলেন্সে নেই কোন ফাস্ট-এইড বক্স।
ফিটনেস এবং সিলিন্ডারের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব সড়ক পরিবহন বিভাগ বিআরটিএ’র। তবে বিআরটিএ এক্ষেত্রে নীরব দশর্কের ভূমিকা পালন করার অভিযোগ রয়েছে।
এবিষয়ে জানতে ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আসমা খানের সাথে কথা বললে তিনি জানান, আমাদের সরকারি অ্যাম্বুলেন্স এর চালক আলমগীর। এই ছেলেটি মূল হোতা হিসেবে কাজ করছে। তাকে একাধিকবার বলার পরেও এই ব্যাপারটি সে এখন পর্যন্ত সমাধান করে না। তাই আজ এমপি মহোদয়ের সঙ্গে ঈশ্বরদী আমবাগান ফাঁড়ির ইনচার্জ শহিদুল ইসলাম কে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে ।
এবিষয়ে ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার আলমগীরের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বিষয়টি এমপি স্যারকে জানিয়েছিলেন, পরে এমপি স্যার আমাকে ডেকে পাঠান। তার সঙ্গে দেখা করলে উনি আমাকে হাসপাতালে এত গাড়ি কেন প্রশ্ন করেন। আমি তাকে বলি, স্যার আমি একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মকর্তা আমার দ্বারা এগুলো করা সম্ভব না, আমিতো হাসপাতালের নেতা না যে আমার কথায় এম্বুলেন্স এখানে থাকবে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দায়িত্ব এগুলো দেখার।