ঈশ্বরদী মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়: ১০ নভেম্বর ১৯৭১
- প্রকাশিত সময় ১২:৪৯:৩০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ২০২১
- / 163
বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান
দ্বিতীয় পর্ব
এই রকম এলোমেলো ভাবনায় ডুবে গিয়ে একটু বেশিরকম অন্যমনষ্ক আর অসতর্ক হয় পড়েছিলাম বোধহয়, কেননা ডানদিক থেকে একজন পাকসেনা এক-পা দু-পা করে কখন যে আমার একেবারে নিকটে চার-পাঁচ ফুটের মধ্যে চলে এসেছে বুঝতেই পারিনি। মনে হলো পাকসেনাটা কী যেন খুঁজছে। নাকি আমাকেই জীবিত ধরতে চায় ব্যাটা! একইসঙ্গে আমাদের চার-চোখের মিলন হওয়া মাত্র আমার অস্ত্রটা আবার গর্জে উঠলো পরপর দু’বার। সৈন্যটা শুধু উহ্ শব্দ কর ঘুরে পড়ে গেলো আমার মাত্র একগজ দূরে। গুলি লেগেছে ওর পেট আর কোমরে; ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এইবার ওর মাথায় ব্যারেল ঠেকিয়ে আরও একবার ট্রিগার টিপলাম। এবার স্তব্ধ হলো চিরদিনের মতো।
যুদ্ধের ময়দান তখন কিছুটা শান্ত। প্রমোদ গুণলাম, আসলে রাজাকারগুলোক পাঠানো হয়েছিল বলরি পাঁঠা হিসেবে, কিংবা শুধুই লুটতরাজ করতে। পরে গোলাগুলির শব্দে এই এলাকায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থান টের পেয়ে ওরা তিনদিক থেকে আমাদেরকে আক্রমণ চালিয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর ঠুস্-ঠাস্ গুলির শব্দ ভেসে আসছে গ্রামের পশ্চিম পাড়ার দিক থেকে। এখন কী করবো ভাবছি, হঠাৎ দেখি আরেকজন পাকসেনা সেই ঝোপের মধ্যে ঢুকে ওদের মৃত সাথীদের লাশের কাছে পড়ে থাকা অস্ত্রগুলো তুলে নিচ্ছে। তাৎক্ষণাৎ গুলি করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমার সে চেষ্টা ব্যর্থ হলো। কারণ, ম্যাগাজিন কখন যে খালি হয়ে পড়েছে তা খেয়াল করিনি। ট্রিগারে আঙ্গুলের চাপ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফাঁকা চেম্বারে প্রিস্টনব্রিজের আঘাতের অতিপরিচিত খটাস্ শব্দটা শুনামাত্র ব্যাগ হাতড়ে গুলিভর্তি নতুন ম্যাগাজিন লাগাতে লাগাতেই চলে গেলো তিন-চার সেকেন্ড সময়, ততক্ষণে দৌড়ে পালিয়ে গেলো শত্রু, আর আমি কিছুই করতে পারলাম না। আমি ভাবলাম, সৈনিকটা তো আমাকে ওই মূহুর্তে জীবীতই ধরতে পারতো, কিংবা গুলি করে হত্যা করলেও কিছু করার ছিল না। তবু একবারও সে আমার দিকে চোখ ফিরে তাকায়নি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, এ যাত্রায় নিস্তার পাওয়ার জন্য। নাহ্, এলাপাতাড়ি গুলি আর খরচ করবো না। আক্কেল আমার হয়েছে। আচম্বিতে ঘটে যাওয়া এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে এবারই প্রথম ভয়ে শিউরে উঠলো গা।
বিকাল তিনটা পর্যন্ত ওই গর্তের মধ্যে চুপচাপ বসে বসে কাটলো আমার যতোক্ষণ না গোলাগুলি থামলো। গর্ত থেকে উঠবো-উঠবো ভাবছি, এমন সময় একজন গ্রামবাসী ওই জঙ্গলের ভিতর ঢুকে মৃত একজন পাকসেনার নাকে-মুখে হাত দিয়ে পরখ করতে শুরু করলো সেনাটা মরেছে নাকি এখনো জ্যান্ত! আমি কোনো কথা না বলে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম সে আমার দিকে তাকায় কিনা সেই অপেক্ষায়। ভাবলাম সে তাকালেই তো আমি তাকে প্রশ্ন করে জানতে পারি পাক-আর্মিরা সবাই চলে গেছে কিনা। মিনিটখানেক পরে সে আমার দিকে তাকালো বটে, কিন্তু এক পলক তাকিয়েই জবাই করা গরুর মতন গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে উর্দ্ধশ্বাসে দিল দৌড়- যেদিক থেকে সে এসেছিল সেদিকে। হয়তো বেচারা ভীষণ ভড়কে গেছে। কারণ আমার মাথায় তখনও আর্মির হেলমেট। লোকটার কান্ডকীর্তি দেখে আমি টেনশনের মধ্যেও না হেসে পারলাম না। ভাবলাম, পরিস্থিতি নিশ্চয়ই এখন স্বাভাবিক, তা না হলে লোকটা এভাবে এখানে আসতে পারতো না। কাজেই আমি এখন গর্ত থেকে উঠতে পারি। উঠে দাঁড়াতেই দেখি চারদিক থেকে বেশকিছু লোকজন আমার দিকে ছুটে আসছে। কাছে এসেই কয়কেজন আমাকে কাঁধে তুলে নাচতে শুরু করে দিল। সেই ডাবলু দৌড়াতে দৌড়াতে এসেই আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললনে, “আরে! তুমি এখনও জীবিত আছো? আমরা তো ধরেই নিয়েছি যে, ওরা তোমাকে মেরে ফেলেছে। কী আশ্চর্য!”
এরপর উনি মৃতদেহগুলো হাতড়াতে শুরু করলেন। একটু পর আমার দিকে এগিয়ে এসে বললনে, “এই নাও, ওদরে পকেটে টাকা, চিঠিপত্র আর হাতঘড়ি পাওয়া গেছে।”
গুণে দেখলাম, আটষট্টি টাকা।
লোকজনের ভীড় বেড়ে যেতে লাগলো। আমি কয়েকজন গ্রামবাসীর সহায়তায় লাশ তিনটা জগন্নাথপুর নিয়ে গেলাম। লাশের দু’হাত-দু’পা দড়ি দিয়ে বেধে মাঝখানে বাঁশ ঢুকিয়ে সামনে-পেছনে দু’জন করে বইয়ে নিয়ে চললাম। আমাদের সঙ্গে বহুলোক। লাশগুলো টেনে নিতে সবাই যেন হিমশিম খেয়ে গেলো। গ্রামের অনেক লোকজন সেই পথ ধরে চর-মিরকামারি থেকে জয়নগর বা জগন্নাথপুরের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল। গুলিবিদ্ধ ফুটফুটে চেহারার এক বালিকাকে দেখলাম, পিঠে গুলি লেগে বুকের ভিতর আটকে আছে। বুকের একখানে সামান্য ফুলে উঠেছে। মেয়েটি তখনও জীবিত। সঙ্গী লোকটাকে বললাম, “তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।”
বাহকদের লাশগুলো কোথাও পুঁতে রাখতে নির্দেশ দিয়ে আমার কোম্পানি কমান্ডারের খোঁজ করলাম। খুঁজতে খুঁজতে জয়নগরের একটা বাড়ির উঠোনে তাঁকে পাওয়া গেলো। সন্ধ্যা নেমেছে তখন। ফর্সা ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবী পরিহিত কোম্পানি কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম মন্টু তখন একটা চেয়ারে বসে কয়েকজন লোকের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। লোকগুলো চারপাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলো মনযোগ দিয়ে। আমি তাকে দেখেই আবেগে তাঁর সঙ্গে কোলাকুলি করলাম। এখানে যে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলো সে হচ্ছে মানিক নগরের আব্দুল বারি, ওর সাথে আরো তিন-চারজন মুক্তিযোদ্ধা। ওরা সবাই আমার সাথেই ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। একপর্যায়ে কোম্পানি কমান্ডার আমার কাছ থেকে পাকসেনাদের দেহতল্লাশি করে পাওয়া হাতঘড়ি, আইডেন্টিটি কার্ড, উর্দুতে লেখা একখানা চিঠি, ফটোগ্রাফ এগুলো নিয়ে বললেন, ”এসব আমাকে দাও, এক্সপার্ট দিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে- ঘড়িতে ওয়্যারলেস থাকতে পারে। আর চিঠিতে কি লেখা আছে সেসব জানতে হবে।”
হাতঘড়ির মধ্যে ওয়্যারলেস? সত্য হতে পারে মাসুদরানা বা জেমস্ বন্ড কাল্পনিক গোয়েন্দা সিরিজের বইয়ে কোনো দুর্ধর্ষ এজেন্টের হাতে থাকা ঘড়ির বেলায়, কিন্তু ব্যাটেলফিল্ডে কোনো সৈনিকের হাতঘড়ির ক্ষেত্রে সেটা অবান্তর বলেই মনে হলো আমার কাছে। যাহোক, এসব ব্যাপারে কথা বাড়ানো অনুচিত মনে করে চুপ করে রইলাম। পরে উনি কী যেন ভেবে টাকাগুলোসহ মানিব্যাটা আবার আমার হাত ফিরিয়ে দিলেন।
সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার ঘণিয়ে আসছে চারদিকে। সেই মূহুর্তে হঠাৎ করে চর-মিরকামারির দিক থেকে হেভি-মেসিনগানের অবিরাম গুলির শব্দ আসতে লাগলো। ওদিক থেকে আবারও লোকজনকে দৌড়াদৌড়ি করে এদিকে চলে আসতে দেখলাম। কিছুক্ষণ পরই দূরের বাড়িঘরগুলো দাউ দাউ জ্বলে উঠলো। সেই আলোতে আলোকিত হয়ে উঠলো এ গ্রামের মাঠঘাট, লোকালয়। কোম্পানি কমান্ডারের কাছে জানতে চাইলাম, “এখন কী করবো? ” কোম্পানি কমান্ডার আত্মস্থ হাসি দিয়ে বললনে, “ওদরে সঙ্গে এখন চ্যালেঞ্জে যাওয়া যাবে না। তাছাড়া তোমরা তো সারাদিন অনাহারে রয়েছো। আওয়ার ফাইট ইজ সাসপেন্ডেড।”
“কিন্তু, ওরা যে গ্রামটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে?” আমি আবারও বললাম। মন্টু মাথা ঝাঁকি দিয়ে বললেন, “যথেষ্ট হয়েছে, হিসেব করেছি- থারটি থ্রি সোলজার্স অব দ্য অপজিসন আ’ কিলড্। আমাদের কোনও লাইফ লস্ হয়নি। নো মোর, মতি। নাউ লিভ ইট।”
ওই তেত্রিশজন পাকসেনার মৃত্যু তিনি কিভাবে নিশ্চিত হয়েছিলেন তা আমি জানি না। তবে এটা ঠিক যে সারাদিনের রিপোর্ট জোগাড়া করা তেমন কোনো কঠিন কাজ ছিলো না।
যুদ্ধের শেষ অধ্যায়ে বৃষ্টির মত বিভিন্ন অস্ত্রের গুলির প্রচন্ড শব্দে মাটি পর্যন্ত কাঁপতে লাগলো। বাড়ির বাইরে এসে ছোট একটা কাঁঠাল গাছের নিচে দাঁড়াই। মিরকামারির দিকে তাকালাম। গ্রামের প্রায় সব বাড়িই তখন দাউ দাউ আগুনে জ্বলছে। সেই আগুনের লেলিহান শিখা চল্লিশ-পঞ্চাশ ফুট বা তারও বেশি উপরে উঠে গেছে। আগুনের আলোয় রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারও আলোময় হয়ে উঠেছে।
এখানে আসবার পথে কয়েকজন সহযোদ্ধা আমাকে ডাক দিয়ে বলেছে, এই যে বীর মুক্তিযোদ্ধা, তুমি সত্যিই একজন বীর! কিন্তু ওদের কথায় কান দেবার মত সময় তখন আমার ছিল না। পেটের ক্ষুধাও কোথায় যেন উবে গেছে তখন। ওই প্রজ্জ্বলিত আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা মুষড়ে গেলো যেন। আমার হাতের মুঠোয় তখনো গুলিভর্তি অস্ত্রটা আছে, আর আমি নীরব-নিথর হতভম্বের ন্যায় ঠাই দাঁড়িয়ে আছি। কিছুই করতে পারছি না। আমি চেয়ে চেয়ে দেখছি গোটা মিরকামারি গ্রামটা কীভাবে আজ হঠাৎ করে মাটির সঙ্গে মিশে গেলো। বার বার মনে হতে লাগলো, এই অঘটন ঘটাবার জন্য আমার সেকসন কমান্ডার আর আমার হঠকারিতাই কি দায়ী?
পরে এই বলে নিজেকে প্রবোধ দিলাম, কিছু মানুষের ক্ষয়-ক্ষতি হয়তো হয়েছে যা কোনোভাবেই পুরণ হবার নয়, কিন্তু স্বাধীনতার জন্য যে যুদ্ধ, মাতৃভূমির জন্য যে যুদ্ধ, জীবন বাজি রেখে যে যুদ্ধ, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে যুদ্ধ, অগণিত মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে যে যুদ্ধ – সে সবের কাছে এই ক্ষতি নিতান্তই সামান্য। এ যুদ্ধে যে আমাদের জয়ী হতেই হবে!
(সমাপ্ত)
বিঃদ্রঃ এ ঘটনা সংক্রান্ত লেখা পূর্বেও অনেকে প্রকাশ করেছেন। লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমানের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
<>আরও পড়ুনঃ ঈশ্বরদী মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়: ১০ নভেম্বর ১৯৭১ (প্রথম পর্ব)>