ঢাকা ০৩:২৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞপ্তি :
সারাদেশের জেলা উপোজেলা পর্যায়ে দৈনিক স্বতঃকণ্ঠে সংবাদকর্মী নিয়োগ চলছে । আগ্রহী প্রার্থীগন জীবন বৃত্তান্ত ইমেইল করুন shatakantha.info@gmail.com // দৈনিক স্বতঃকণ্ঠ অনলাইন ও প্রিন্ট পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন ০১৭১১-৩৩৩৮১১, ০১৭৪৪-১২৪৮১৪

মুজিব বাহিনী: পর্ব-১

বার্তাকক্ষ
  • প্রকাশিত সময় ১০:৩৫:৩৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২১
  • / 352

বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান
বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান

বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেস (ইংরেজী: Bangladesh Liberation Forces) ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী মুক্তিবাহিনীর একটি বিশেষ অংশ যা সাধারণতঃ মুজিব বাহিনী নামে অভিহিত হতো। অন্যভাবে এই বাহিনীকে ‘পলিটিক্যাল কমাণ্ডো’ও বলা হতো।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের শেষের দিকে শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ ও সিরাজুল আলম খান – এই চার যুবনেতার উদ্যোগে এই বিশেষ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এই বাহিনী অস্থায়ী মুজিব নগর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভুত ছিল। একই সঙ্গে এই বাহিনী স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সেনাপতি জেনারেল অরোরার নিয়ন্ত্রণেরও বাইরে ছিল। এই বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল সুজন সিং উবান, যিনি ভারতীয় স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কমাণ্ডার (ইন্সপেক্টর জেনারেল) ছিলেন।

ভারতের ভূখণ্ডে দেরাদুন নামক একটি গোপন স্থানে এই বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো যার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার টি. এস ওবেরয়। কর্ণেল বি ডি কুশাল এই বাহিনীর প্রশাসনিক বিষয়াদি দেখাশোনা করতেন।

মেজর জেনারেল এস. এস. উবান ১৯৯৫-এ প্রকাশিত তাঁর লিখিত ‘ফ্যান্টমস্‌ অব চিটাগাং’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, মুজিববাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সহযোগী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছে। সারাদেশে এই বাহিনীর মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৫ হাজার।

মুক্তিযুদ্ধের শেষে স্বাধীন বাংলাদেশে রক্ষীবাহিনী নামে বর্তমান র‌্যাব-এর আদলে একটি এলিট ফোর্স গঠিত হয় (৮ মার্চ ১৯৭২)। এ সময় বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেস বা মুজিব বাহিনীর প্রায় সব সদস্যকে নবগঠিত রক্ষীবাহিনীতে আত্মীকরণ করা হয়। রক্ষীবাহিনীর পরিচালক নিযুক্ত হন সেক্টর কমান্ডার এ.এন.এম. নূরুজ্জামান। ১৯৭১ সালে অবিভক্ত পাবনা জেলায় (সিরাজগঞ্জ সহ) মুজিব বাহিনীর জেলা কমাণ্ডার ছিলেন রফিকুল ইসলাম বকুল আর ঈশ্বরদীর আঞ্চলিক কমাণ্ডার ছিলেন নূরুজ্জামান বিশ্বাস।]


মুজিব বাহিনী: মুক্তিযুদ্ধের অকথিত অধ্যায়

(মুক্তিবাহিনীর সবচেয়ে বড় অংশটি এসেছিল ছাত্রদের মধ্য থেকে। তারা একই সঙ্গে ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের অনুসারী। আদর্শগত সংঘাত এবং ভিন্ন নেতৃত্বকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতা তাদের মধ্যে প্রবল ছিল। সেদিক থেকে আদর্শ গেরিলা ছিলেন মাটি থেকে উঠে আসা কৃষক শ্রেণীর লোকজন। তাঁদের মিথ্যা অহম ছিল না, একজোড়া জাঙ্গলবুটের জন্য হাপিত্যেশও তাঁরা করেননি, খাবার না পেলে খাননি, পরিধেয় বা বিছানা নিয়েও মাথা ঘামাননি। স্রেফ স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে নিয়ে তাঁরা মাটি কামড়ে লড়ে গেছেন…মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে ভারতীয় সামরিক হাই কমান্ডের মূল্যায়ন)

মুক্তিযুদ্ধের মাঝপথে আচমকাই রণাঙ্গনে নতুন একটি নাম ছড়িয়ে পড়ল_মুজিব বাহিনী। নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি গণবাহিনীর যোদ্ধারা যখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছেন, তখন আচমকা একটি নতুন বাহিনী কী কারণে কিভাবে জন্ম নিল, তা ছিল এক বড় রহস্য। তারা মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বাধীন ছিল না। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী কিংবা পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়ক লে. জেনারেল অরোরাও তাদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পাননি। মূলত মার্চের আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ছাত্রলীগের তিন জঙ্গি ছাত্রনেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও সিরাজুল আলম খান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন এই বাহিনীর নেতৃত্বে।
অভিযোগ আছে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা Research & Analysis Wing (RAW)এর বিশেষ তত্ত্বাবধানে এবং বিখ্যাত সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল সুজন সিং উবানের ট্রেনিংয়ে ১০ হাজার সদস্যের এই এলিট বাহিনী যতখানি মুক্তিযুদ্ধ করেছে তারও বেশি দুর্নাম কুড়িয়েছে বামপন্থী নির্মূল অভিযানে। অথচ মুজিব বাহিনী সম্পর্কে জানতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে হাসানুল হক ইনুর মতো বামপন্থী নেতা-কর্মীরাও মুজিব বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইনু ছিলেন মুজিব বাহিনীর রাজনৈতিক প্রশিক্ষকদের একজন। মুজিব বাহিনীর অনেকেই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে নামার সুযোগ পাননি। আবার স্বাধীনতার পর তাঁরাই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়েছেন রক্ষীবাহিনী ও গণবাহিনীর আদলে।

রহস্যময় ‘সানী ভিলা’
কলকাতা ভবানীপুর পার্কের পাশে হালকা গোলাপি রঙের একটি দোতলা বাড়ি। বাসিন্দাদের নাম তপুবাবু, রাজুবাবু, সরোজবাবু, মনিবাবু, মধুবাবু। আশপাশের মানুষ তা-ই জানে। কিন্তু ঠিকানা ধরে যখন কেউ সেখানে যায় তখন তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় ছদ্মনামগুলো। তপু ওরফে তোফায়েল আহমেদ, রাজু ওরফে আবদুর রাজ্জাক, সরোজ আ কা সিরাজুল আলম খান, ফজলুল হক মনি ওরফে মনিবাবু এবং বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী মুন্সীগঞ্জের মহিউদ্দিন বা মন্টুবাবু। ৯ নম্বর সেক্টর থেকে নির্দেশ পেয়ে আসা বরিশাল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুর রহমান মোস্তফার জবানিতে : বাড়ির দোতলায় একটি কক্ষে তোফায়েল ভাই, রাজ্জাক ভাইসহ আরো কয়েকজন আমাকে নিয়ে বৈঠক করলেন। ওই বৈঠকে বসে জানলাম, আগরতলায় শেখ ফজলুল হক মনিসহ ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও কৃষক লীগের ভারতে আগত সদস্যদের নিয়ে মুজিব বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আগরতলাতে হেডকোয়ার্টার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে নাকি বেশ কয়েক হাজার মুজিব বাহিনীর সদস্য ভারতের দুর্গম পার্বত্য এলাকা টেন্ডুয়া (তানদুয়া) প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ট্রেনিং নেওয়া আরম্ভ করেছেন।

২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোডের ‘সানী ভিলা’ নামের এই বাড়িটির মালিক প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সুতার।

পিরোজপুরের বাটনাতলার এই অধিবাসী পাকিস্তান কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন এবং কংগ্রেস নেতা প্রণব কুমার সেনের মেয়েকে বিয়ে করেন। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে জয়ী হন, অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতে ভারতে চলে যান। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে আবারও নির্বাচিত হন এবং ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের ভাষ্য অনুযায়ী চিত্তরঞ্জনের মাধ্যমেই মেজর জেনারেল উবানের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁদের। মার্চের উত্তাল দিনগুলো শুরু হওয়ার অনেক আগেই (১৮ ফেব্রুয়ারি) বঙ্গবন্ধু উল্লেখিত চার নেতাকে এই বাড়িটির ঠিকানা দিয়ে দেন এবং চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে দেখা করে অস্ত্র ও ভারতীয় সহায়তা নেওয়ার নির্দেশ দেন। অবশ্য ২৫ মার্চের আগে আরেকবার ডা. আবু হেনাকে ছাত্রনেতাদের প্রতিনিধি হিসেবে সুতারের কাছে পাঠানো হয় সব কিছু ঠিকঠাক আছে কি না জানতে। মোটামুটি ‘সানী ভিলা’কেই ধরে নেওয়া যায় ‘মুজিব বাহিনী’র জন্মস্থান হিসেবে। এখানেই উবানের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রস্তাবিত বাহিনীর খসড়া পরিকল্পনাটি জানান মনি-সিরাজ-রাজ্জাক-তোফায়েল। এই বৈঠকে সুতার ছাড়া উপস্থিত ছিলেন আ স ম আবদুর রবও। (চলবে…..)

লেখা: বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান, ঈশ্বরদী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও হোমিও চিকিৎসক।

সহায়তা/উৎস: অমি রহমান পিয়াল, লেখক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, ব্লগার, বর্তমানে প্রবাসী।

মুজিব বাহিনী: পর্ব-১

প্রকাশিত সময় ১০:৩৫:৩৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২১

বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান
বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান

বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেস (ইংরেজী: Bangladesh Liberation Forces) ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী মুক্তিবাহিনীর একটি বিশেষ অংশ যা সাধারণতঃ মুজিব বাহিনী নামে অভিহিত হতো। অন্যভাবে এই বাহিনীকে ‘পলিটিক্যাল কমাণ্ডো’ও বলা হতো।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের শেষের দিকে শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ ও সিরাজুল আলম খান – এই চার যুবনেতার উদ্যোগে এই বিশেষ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এই বাহিনী অস্থায়ী মুজিব নগর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভুত ছিল। একই সঙ্গে এই বাহিনী স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সেনাপতি জেনারেল অরোরার নিয়ন্ত্রণেরও বাইরে ছিল। এই বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল সুজন সিং উবান, যিনি ভারতীয় স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কমাণ্ডার (ইন্সপেক্টর জেনারেল) ছিলেন।

ভারতের ভূখণ্ডে দেরাদুন নামক একটি গোপন স্থানে এই বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো যার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার টি. এস ওবেরয়। কর্ণেল বি ডি কুশাল এই বাহিনীর প্রশাসনিক বিষয়াদি দেখাশোনা করতেন।

মেজর জেনারেল এস. এস. উবান ১৯৯৫-এ প্রকাশিত তাঁর লিখিত ‘ফ্যান্টমস্‌ অব চিটাগাং’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, মুজিববাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সহযোগী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছে। সারাদেশে এই বাহিনীর মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৫ হাজার।

মুক্তিযুদ্ধের শেষে স্বাধীন বাংলাদেশে রক্ষীবাহিনী নামে বর্তমান র‌্যাব-এর আদলে একটি এলিট ফোর্স গঠিত হয় (৮ মার্চ ১৯৭২)। এ সময় বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেস বা মুজিব বাহিনীর প্রায় সব সদস্যকে নবগঠিত রক্ষীবাহিনীতে আত্মীকরণ করা হয়। রক্ষীবাহিনীর পরিচালক নিযুক্ত হন সেক্টর কমান্ডার এ.এন.এম. নূরুজ্জামান। ১৯৭১ সালে অবিভক্ত পাবনা জেলায় (সিরাজগঞ্জ সহ) মুজিব বাহিনীর জেলা কমাণ্ডার ছিলেন রফিকুল ইসলাম বকুল আর ঈশ্বরদীর আঞ্চলিক কমাণ্ডার ছিলেন নূরুজ্জামান বিশ্বাস।]


মুজিব বাহিনী: মুক্তিযুদ্ধের অকথিত অধ্যায়

(মুক্তিবাহিনীর সবচেয়ে বড় অংশটি এসেছিল ছাত্রদের মধ্য থেকে। তারা একই সঙ্গে ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের অনুসারী। আদর্শগত সংঘাত এবং ভিন্ন নেতৃত্বকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতা তাদের মধ্যে প্রবল ছিল। সেদিক থেকে আদর্শ গেরিলা ছিলেন মাটি থেকে উঠে আসা কৃষক শ্রেণীর লোকজন। তাঁদের মিথ্যা অহম ছিল না, একজোড়া জাঙ্গলবুটের জন্য হাপিত্যেশও তাঁরা করেননি, খাবার না পেলে খাননি, পরিধেয় বা বিছানা নিয়েও মাথা ঘামাননি। স্রেফ স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে নিয়ে তাঁরা মাটি কামড়ে লড়ে গেছেন…মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে ভারতীয় সামরিক হাই কমান্ডের মূল্যায়ন)

মুক্তিযুদ্ধের মাঝপথে আচমকাই রণাঙ্গনে নতুন একটি নাম ছড়িয়ে পড়ল_মুজিব বাহিনী। নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি গণবাহিনীর যোদ্ধারা যখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছেন, তখন আচমকা একটি নতুন বাহিনী কী কারণে কিভাবে জন্ম নিল, তা ছিল এক বড় রহস্য। তারা মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বাধীন ছিল না। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী কিংবা পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়ক লে. জেনারেল অরোরাও তাদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পাননি। মূলত মার্চের আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ছাত্রলীগের তিন জঙ্গি ছাত্রনেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও সিরাজুল আলম খান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন এই বাহিনীর নেতৃত্বে।
অভিযোগ আছে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা Research & Analysis Wing (RAW)এর বিশেষ তত্ত্বাবধানে এবং বিখ্যাত সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল সুজন সিং উবানের ট্রেনিংয়ে ১০ হাজার সদস্যের এই এলিট বাহিনী যতখানি মুক্তিযুদ্ধ করেছে তারও বেশি দুর্নাম কুড়িয়েছে বামপন্থী নির্মূল অভিযানে। অথচ মুজিব বাহিনী সম্পর্কে জানতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে হাসানুল হক ইনুর মতো বামপন্থী নেতা-কর্মীরাও মুজিব বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইনু ছিলেন মুজিব বাহিনীর রাজনৈতিক প্রশিক্ষকদের একজন। মুজিব বাহিনীর অনেকেই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে নামার সুযোগ পাননি। আবার স্বাধীনতার পর তাঁরাই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়েছেন রক্ষীবাহিনী ও গণবাহিনীর আদলে।

রহস্যময় ‘সানী ভিলা’
কলকাতা ভবানীপুর পার্কের পাশে হালকা গোলাপি রঙের একটি দোতলা বাড়ি। বাসিন্দাদের নাম তপুবাবু, রাজুবাবু, সরোজবাবু, মনিবাবু, মধুবাবু। আশপাশের মানুষ তা-ই জানে। কিন্তু ঠিকানা ধরে যখন কেউ সেখানে যায় তখন তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় ছদ্মনামগুলো। তপু ওরফে তোফায়েল আহমেদ, রাজু ওরফে আবদুর রাজ্জাক, সরোজ আ কা সিরাজুল আলম খান, ফজলুল হক মনি ওরফে মনিবাবু এবং বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী মুন্সীগঞ্জের মহিউদ্দিন বা মন্টুবাবু। ৯ নম্বর সেক্টর থেকে নির্দেশ পেয়ে আসা বরিশাল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুর রহমান মোস্তফার জবানিতে : বাড়ির দোতলায় একটি কক্ষে তোফায়েল ভাই, রাজ্জাক ভাইসহ আরো কয়েকজন আমাকে নিয়ে বৈঠক করলেন। ওই বৈঠকে বসে জানলাম, আগরতলায় শেখ ফজলুল হক মনিসহ ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও কৃষক লীগের ভারতে আগত সদস্যদের নিয়ে মুজিব বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আগরতলাতে হেডকোয়ার্টার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে নাকি বেশ কয়েক হাজার মুজিব বাহিনীর সদস্য ভারতের দুর্গম পার্বত্য এলাকা টেন্ডুয়া (তানদুয়া) প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ট্রেনিং নেওয়া আরম্ভ করেছেন।

২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোডের ‘সানী ভিলা’ নামের এই বাড়িটির মালিক প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সুতার।

পিরোজপুরের বাটনাতলার এই অধিবাসী পাকিস্তান কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন এবং কংগ্রেস নেতা প্রণব কুমার সেনের মেয়েকে বিয়ে করেন। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে জয়ী হন, অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতে ভারতে চলে যান। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে আবারও নির্বাচিত হন এবং ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের ভাষ্য অনুযায়ী চিত্তরঞ্জনের মাধ্যমেই মেজর জেনারেল উবানের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁদের। মার্চের উত্তাল দিনগুলো শুরু হওয়ার অনেক আগেই (১৮ ফেব্রুয়ারি) বঙ্গবন্ধু উল্লেখিত চার নেতাকে এই বাড়িটির ঠিকানা দিয়ে দেন এবং চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে দেখা করে অস্ত্র ও ভারতীয় সহায়তা নেওয়ার নির্দেশ দেন। অবশ্য ২৫ মার্চের আগে আরেকবার ডা. আবু হেনাকে ছাত্রনেতাদের প্রতিনিধি হিসেবে সুতারের কাছে পাঠানো হয় সব কিছু ঠিকঠাক আছে কি না জানতে। মোটামুটি ‘সানী ভিলা’কেই ধরে নেওয়া যায় ‘মুজিব বাহিনী’র জন্মস্থান হিসেবে। এখানেই উবানের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রস্তাবিত বাহিনীর খসড়া পরিকল্পনাটি জানান মনি-সিরাজ-রাজ্জাক-তোফায়েল। এই বৈঠকে সুতার ছাড়া উপস্থিত ছিলেন আ স ম আবদুর রবও। (চলবে…..)

লেখা: বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান, ঈশ্বরদী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও হোমিও চিকিৎসক।

সহায়তা/উৎস: অমি রহমান পিয়াল, লেখক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, ব্লগার, বর্তমানে প্রবাসী।