মুজিব বাহিনী: (পর্ব-২)
- প্রকাশিত সময় ০৫:০১:৪৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ নভেম্বর ২০২১
- / 371
বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান
‘জয় বাংলা বাহিনী’র উত্তরসূরি
এই পর্যায়ে এসে আমাদের কিছু চমকপ্রদ প্রাসঙ্গিক ইতিহাস জানা হয়। মুজিব বাহিনীর পেছনে যাঁরা ছিলেন তাঁরা একই সঙ্গে আবার সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদেরও সদস্য, যার সূচনা সেই ১৯৬২ সালে। বলা হয়, ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী এই সংগঠনটির মূল পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে একদম শুরু থেকেই। ১৯৬২ সালে সিরাজুল আলম খান, রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করার জন্য এই বিপ্লবী পরিষদের জন্ম দেন। ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদ বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। এটির অস্তিত্ব প্রকাশ হয় ১৯৭২ সালে যখন ছাত্রলীগে মতভেদ চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং সিরাজুল আলম খান তাঁর অধীনদের নিয়ে জাসদ গড়তে যান। বঙ্গবন্ধুকে এ সম্পর্কে জানানো হয় ১৯৬৯ সালে তিনি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ থেকে মুক্ত হয়ে ফেরার পর। রাজ্জাকের ভাষ্যমতে, মুক্তিযুদ্ধ যখন প্রায় অনিবার্য রূপ নিতে যাচ্ছে তার আগে মনি ও তোফায়েলকে এই পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করেন তাঁরা। এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৮ জানুয়ারি (মাসুদুল হকের ভাষ্যে ফেব্রুয়ারি হবে) একান্ত বৈঠক করেন। সেখানেই তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয় সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে। চারজনকে এই রূপরেখার কো-অর্ডিনেটর করা হয়।
বিপ্লবী পরিষদে তাজউদ্দীন আহমদকে অন্তর্ভুক্ত করতে নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। মার্চের পর সবাই ঠিকানামতো (সানী ভিলা) গিয়ে জানতে পারেন তাজউদ্দীন সেখানে যাননি। তিনি প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন।
তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, এই পরিকল্পনাটি আরো আগেই নিয়েছিলেন মুজিব। ১৯৬৯ সালে লন্ডন থেকে ফেরার পর তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য তাঁর একটি বিশেষ পরিকল্পনার কথা জানান। আর এই উদ্দেশ্যে প্রতি মাসে ২৫ জন নির্বাচিত যোদ্ধাকে ভারতে বিশেষ ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। যোদ্ধা বাছাইয়ের দায়িত্ব পান মনি-সিরাজ-রাজ্জাক ও তোফায়েল। কিন্তু এর মধ্যেই সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় পরিকল্পনাটি স্থগিত রাখা হয়। ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় নিহত সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে ছাত্রলীগ। আর এর একাংশ থেকে ‘১৫ ফেব্রুয়ারি বাহিনী’ নামে একটি দল মার্চপাস্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরে। এই মিছিলে ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তবে এই বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে ফজলুল হক মনি এবং ডাকসু সহসভাপতি আ স ম রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন কিছুই জানতেন না। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নগর ছাত্রলীগ সভাপতি মফিজুর রহমান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু। এখানে স্পষ্টতই চার নেতার মধ্যে আদর্শগত ক্ষেত্রে খানিকটা মতবিরোধের আঁচ পাওয়া যায়। আর তার প্রকাশ সে বছরই ১২ আগস্ট ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সেখানে ৩৬-৯ ভোটে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাবটি পাস হয়। নূরে আলম সিদ্দিকী, মাখনসহ যাঁরা বিরোধিতা করেন তাঁরা সবাই শেখ মনির অনুসারী। মনি তখন ছাত্র নন, কিন্তু ছাত্রলীগের একটি অংশকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর অনুসারীদের হারিয়ে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন অংশটির এই জয় দুজনের শীতল সম্পর্ককে আরো শীতল করে দেয়। আর এর প্রভাব মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনীতে তেমন না পড়লেও স্বাধীনতার পর মারাত্মক রূপ নেয় এবং রক্ষীবাহিনী-গণবাহিনীর সংঘর্ষে এর ভয়াবহ প্রকাশ ঘটে। যুদ্ধকালীন আবদুর রাজ্জাকই মূলত সিরাজ-মনির মধ্যকার ভারসাম্য বজায় রাখতে অবদান রাখেন। তবে মুজিব বাহিনীর মূল পরিকল্পনায় তখনকার ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী ও শাজাহান সিরাজকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। দুজনেই মনির অনুসারী ছিলেন।
বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের ওই ট্রাম্পের আগে জন্ম ‘জয় বাংলা বাহিনী’র। মূলত ছয় দফার ঘোষণা বার্ষিকী ৭ জুনকে সামনে রেখে এটি গঠিত হয়। ‘১৫ ফেব্রুয়ারি বাহিনী’র সদস্যরা স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত নন_এই বিচারে আরেকটু জঙ্গি হিসেবে এই সংগঠনের জন্ম। সিদ্ধান্ত হয়, সেদিন শহীদ মিনার থেকে পূর্ণ সামরিক কায়দায় মার্চপাস্ট করে তাঁরা পল্টন ময়দান যাবেন। পল্টনে সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানাতে শ্রমিক লীগের কর্মসূচি আর তাতে গার্ড অব অনার দেওয়ার কথা ছাত্রলীগের। আগের রাতে, অর্থাৎ ৬ জুন ইকবাল হলে ‘জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা’র নকশা করেন কুমিল্লা থেকে হঠাৎ ঢাকায় আসা শিব নারায়ণ দাস। এটিই পরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকায় পরিণত হয়। ৪২ বলাকা ভবনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় অফিসের লাগোয়া ‘নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্স’ থেকে তৈরি হয় স্বাধীন বাংলার মানচিত্র সংবলিত সেই প্রথম পতাকা, যা সেলাই করেন আবদুল খালেক মোহাম্মদী। ‘জয় বাংলা বাহিনী’ পরিকল্পনা মতো মার্চ করে পল্টনে যায়, কিন্তু পতাকাটি গোটানো অবস্থায় বয়ে নিয়ে যান আ স ম রব। মিছিলে ওড়ে ছাত্রলীগের পতাকা, যা থাকে ইনুর হাতে। অভিবাদন মঞ্চে হাঁটু গেড়ে মুজিবকে পতাকাটি উপহার দেন রব। মুজিব সেটা খুলে দেখেন এবং আবার গুটিয়ে রবকে ফেরত দেন। এর পর এটি ইনুর হাত ঘুরে হাতে পান ছাত্রলীগ নগর সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় আবার ওড়ে সেই ‘জয় বাংলা বাহিনী’র পতাকা। এর পর তা হয়ে যায় জাতির পতাকা, জাতীয় পতাকা। শেখ মুজিব জানতেন ‘জয় বাংলা বাহিনী’র অস্তিত্বের কথা। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের বদলে প্রতিরোধ দিবস পালন করে আওয়ামী লীগ। সেদিন পল্টনে আবারও ওড়ে পতাকা। আর এদিন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে নিজের বাসা থেকে দর্শনার্থীদের উদ্দেশে মুজিবের বক্তৃতায় আসে ‘জয় বাংলা বাহিনী’র নাম। মার্চজুড়েই এরা ডামি রাইফেল নিয়ে ছাত্রলীগকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। মোটামুটি একটা মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া হয় সশস্ত্র সংগ্রামের।
তাজউদ্দীনের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করেই মুজিব বাহিনী!
ফেব্রুয়ারিতে মুজিবের সঙ্গে চার ছাত্রনেতার বৈঠকের ব্যাপারটি তাজউদ্দীনের গোচরে ছিল। কিন্তু কলকাতায় যাওয়ার পর তাঁদের উপেক্ষা করে একক সিদ্ধান্তে এগিয়ে যান তিনি। বিভিন্ন সূত্রে এটা আগেও অনেকবার উল্লেখ হয়েছে যে তাজউদ্দীনের এই প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ একদমই মেনে নিতে পারেননি শেখ মনিসহ বাকিরা। তাঁদের দাবি ছিল, মুক্তিযুদ্ধ চলবে একটি বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিলের অধীনে আর এর নেতৃত্ব দেবেন তাঁরা চারজন_বঙ্গবন্ধু তাঁদেরই মনোনীত করে গেছেন এ জন্য। গ্রহণযোগ্যতা ও অন্যান্য প্রেক্ষাপটে এই দাবিটি উপেক্ষা করা অবশ্যই আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে উপকৃত করেছে।
তাজউদ্দীনের ব্যাপারে এই তরুণ নেতাদের বড় অভিযোগটি ছিল বঙ্গবন্ধু আর ফিরবেন না_এটা ধরে নিয়ে তাজউদ্দীন যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। পাশাপাশি তিনি মওলানা ভাসানীসহ বাম দলগুলোর সদস্যদেরও গুরুত্ব দিচ্ছেন। এর পেছনে আমীর-উল ইসলাম ও মাঈদুল ইসলামকে (মূলধারা ‘৭১-এর লেখক) দায়ী করেন তাঁরা। তাঁদের আশঙ্কা জাগে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব বামপন্থীদের কবজায় চলে যাবে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স নামের একটি বিশেষ বাহিনীর পরিকল্পনা নেন চারজন। আর তার ‘মুজিব বাহিনী’ নামকরণের পেছনে কারণ মুজিববাদ (জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র) কায়েম করা। এ বিষয়ে জে. উবান তাঁর বইয়ে লিখেছেন, Because of their single-minded loyalty to Mujib and their closeness to him, they were more eager to be known as the Mujib Bahini. They had been issuing certificates of genuineness, selecting from their old colleagues. Choosing enough sacrificing, upright and faithful men from Bangladesh, they were putting pressure that they should receive unconventional training in fighting techniques unlike the commando training received by members of the Mukti Bahini.(চলবে……)
লেখা: বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান, ঈশ্বরদী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও হোমিও চিকিৎসক।
সহায়তা/উৎস: অমি রহমান পিয়াল, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, ব্লগার, বর্তমানে প্রবাসী।