ঢাকা ০৭:০০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞপ্তি :
সারাদেশের জেলা উপোজেলা পর্যায়ে দৈনিক স্বতঃকণ্ঠে সংবাদকর্মী নিয়োগ চলছে । আগ্রহী প্রার্থীগন জীবন বৃত্তান্ত ইমেইল করুন shatakantha.info@gmail.com // দৈনিক স্বতঃকণ্ঠ অনলাইন ও প্রিন্ট পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন ০১৭১১-৩৩৩৮১১, ০১৭৪৪-১২৪৮১৪

মুজিব বাহিনী (পর্ব-৩)

বার্তাকক্ষ
  • প্রকাশিত সময় ১১:০৮:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ নভেম্বর ২০২১
  • / 153

বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান
বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান

‘স্যামস বয়েজ’: ভারতের গোপনে লালিত সংগঠন
১৯৭১ সালের মে মাসের শুরুতে ‘সানী ভিলা’র সেই বৈঠকে মে.জেনারেল উবানকে তাঁদের পরিকল্পনা জানান চার নেতা। উবান তাঁর বইয়ে লিখেছেন, পরিকল্পনাটি তাঁর খুবই পছন্দ হয়। মুজির বাহিনীর গঠন এবং প্রশিক্ষণের ব্যাপারটা পুরোটাই গোপনে ব্যবস্থা করা হয়; আর এ ব্যাপারে ভারতীয় সেনাপ্রধান এবং ওয়ার কাউন্সিল হেড জেনারেল স্যাম মানেকশ ছাড়া আর কেউই কিছু জানতেন না। এ কারণে মুজির বাহিনীকে ‘স্যামস বয়েজ’ নামে উল্লেখ করতো ভারতীয় বাহিনী। উবান জানাচ্ছেন, পরে তাজউদ্দিনকে মানেকশ সরাসরি বলেছেন যে সেনাবাহিনীর বিশেষ দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য মানেকশ নিজেই গড়ে তুলেছেন এই বাহিনী। ভারতে নির্বাসিত তিব্বতিদের নিয়ে গড়া স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সফল রূপকার উবানকে দায়িত্বটা দেওয়া হয় ওপর মহল থেকে। ‘র’প্রধাণ আরএন কাও, যিনি একই সঙ্গে ভারতীয় কেবিনেট সেক্রেটারিয়েটের সচিব ছিলেন, উবান মুজিব বাহিনী বিষয়ে সরাসরি শুধু তাঁকেই রিপোর্ট করতেন।

২৯ মে মোট ২৫০ জনের প্রথম দলটি দেরাদুনের দেড় কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি শহর তানদুয়াতে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে। এদিকে মেঘালয়ের হাফলংয়ে আরেকটি ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়, কিন্তু একটি ব্যাচ সেখানে ট্রেনিং নেওয়ার পর পরই সেই ক্যাম্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণে ভারতীয় সেনা বাহিনীর কর্মকর্তারা। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মেজর মালহোত্রা যিনি পরে রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষকেরও দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যেকার আটজনকে বাছাই করা হয় পরবর্তী ব্যাচের প্রশিক্ষক হিসাবে – হাসানুল হক ইনু, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, আফম মাহবুবুল হক, রফিকুজ্জামান, মাসুদ আহমেদ রুমী (প্রয়াত ক্রীড়া সাংবাদিক), সৈয়দ আহমদ ফারুক, তৌফিক আহমেদ ও মোহনলাল সোম। পরে প্রশিক্ষকের সংখ্যা বাড়িয়ে ৫২ জন করা হয়, ২০ নভেম্বর ১৯৭১ মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং বন্ধ করে দেওয়া হয়। যে পর্যন্ত ১০ হাজার মুজিব বাহিনী সদস্য প্রশিক্ষণ নেন। নেতাদের মধ্যে আব্দুর রাজ্জাকই প্রথম ব্যাচের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ সামরিক ট্রেনিং নেন, বাকিটা নেন প্রাথমিক প্রশিক্ষণ।

মুজিব বাহিনীর সাংগঠনিক রূপরেখা
বাংলাদেশকে মোট ৪টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। মুজিব বাহিনীর অপারেশনের জন্য। উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টর কমান্ডার ছিলেন সিরাজুল আলম খান, যাঁর আওতায় ছিল বৃহত্তর রংপুর, রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর। তাঁর সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনি। দক্ষিণাঞ্চলীয় সেক্টর (বৃহত্তর খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালি) ছিল তোফায়েল আহমেদের অধীনে, সহঅধিনায়ক ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ। শেখ ফজলুল হক মনির কমান্ডে ছিল পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টর (বৃহত্তর ঢাকার কিছু অংশ, বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালি, সিলেট। তাঁর সহঅধিনায়ক ছিলেন আসম আ. রব ও মাখন। আব্দুর রাজ্জাকের দায়িত্বে ছিল কেন্দ্রীয় সেক্টর যা গঠিত ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও ঢাকার বাকি অংশ নিয়ে। তাঁর সহঅধিনায়ক ছিলেন সৈয়দ আহমদ। চার নেতা ছিলেন জেনারেল সমমর্যাদার, তাঁদের যাতায়াতের জন্য হেলিকপ্টার বরাদ্দ ছিল, প্রত্যেক সেক্টরের জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ ছিল যা বন্টনের দায়িত্ব ছিল নেতাদের হাতে।

আলাদা ওয়্যারলেস সিস্টেম, আলাদা কোডের অধিনে মুজিব বাহিনী ছিল আদতে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের একদল যোদ্ধা। পাঁচ বছর মেয়াদী একটি পরিকল্পনা নিয়ে এই বাহিনী গঠন করা হয়। প্রাথমিক পরিকল্পনায় ছিল দেশের মধ্যে ছোট ছোট পকেট তৈরি করা, সেসব পকেটে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল বানানো। প্রতিটি থানায় (বর্তমানে উপজেলা) কমপক্ষে পাঁচজনের একটি সেল তৈরি করা হতো যার দায়িত্বে থাকতেন একজন সংগঠক ও তাঁর সহকারী। আশ্রয়স্থলের জন্য একজন নেতা থাকতেন এং বাকি দুজনের দায়িত্ব ছিল বাহকের। এরপর সেখানে যোদ্ধারা আশ্রয় নিয়ে লড়াই শুরু করবেন, প্রতিবিপ্লবী ও পাকবাহিনীর দালালদের হত্যা করবেন। আর মুক্তাঞ্চল তৈরি হবার পর তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে মুজিববাদের ভিত্তিতে।

মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতিত্ব ছিনতাই: বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া
সে সময় কলকাতা থেকে আওয়ামী লীগের প্রচারপত্র হিসেবে বের হতো সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’। কিন্তু আলোড়ন তুলল শেখ মনি সম্পাদিত সাপ্তাহিক বাংলার বাণী। একদল তরুণ সাংবাদিকের এই পত্রিকাটি অল্প সময়ে গ্রহণযোগ্যতা পেল পশ্চিম বঙ্গের সাংবাদিক মহলে।

বাংলার বাণীর খবর প্রকাশের ধরনে রুষ্ট হলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানী। বাংলার বাণীতে বাংলাদেশের যেকোনো রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের যেসব খবর ছাপা হতো তাতে মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিবাহিনী না লিখে মুজিব বাহিনী লেখা হতো। মুক্তিবাহিনী সদর দফতরে জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলামের ভাষ্যে: বাংলার বাণীতে যেদিন প্রথম মুক্তিবাহিনীর স্থলে মুজিব বাহিনী লেখা হলো, সেদিন কর্ণেল ওসমানী আমাকে ডেকে নিয়ে খুবই কড়া ভাষায় আমাকে বললেন, নজরুল সাহেব, মুজিব বাহিনী কি? ওসব কারা লিখছে? কেন লিখছে? আপনি এসব তদন্ড করে জানাবেন আর বলবেন যেন ভবিষ্যতে মুজিব বাহিনী আর না লেখা হয়। এতে করে আমাদের নিয়মিত বাহিনীতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।

দিন কয়েক পর নজরুল জানালেন তাঁর তদন্তের ফল। ‘বললাম, স্যার এই পত্রিকা শেখ ফজলুল হক মনি সাহেবে। এ কথা বলতেই ওসমানী সাহেবের উন্নত গোঁফগুলো নুয়ে গেল। এরপর হু বলে একটা গম্ভীর ধরনের শ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে। খানিকপর তাঁর মুখ থেকে বেরোল: সবকিছুতে একটা ডিসিপ্লিন আছে। এখানে আমরা রং-তামাশা করতে আসিনি। বিদেশের মাটিতে আমরা যে বিশৃঙ্খলা ও অনৈক্য দেখাচ্ছি তা জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়, নজরুল সাহেব। এতে আমাদের সম্পর্কে এদের ধারনা খুব খারাপ হবে। আর আমাদের এই অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলার কথা কি মনে করেন কলকাতার এই চার দেয়ালের ভেতর বন্দী থাকবে? শত্রুপক্ষ এর সুবিধা নিশ্চয়ই নেবে। আপনি-আমি এখানে বসে নানা বাহিনী গঠন করি, আর যে ছেলেটি বাংলাদেশের পথে-জঙ্গলে কিংবা নদীতে ট্রিগারে আঙ্গুল লাগিয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে শত্রু হননের অপেক্ষায় বসে রয়েছে তার কথা কি আমরা চিন্তা করি? বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আনব।’ (চলবে…..)

লেখা: বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মতিউর রহমান, ঈশ্বরদী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, কলামিষ্ট।

সহায়তা/উৎস: অমি রহমান পিয়াল, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, ব্লগার, বর্তমানে প্রবাসী।

আরও পড়ুনঃ মুজিব বাহিনী: পর্ব-১

আরও পড়ুনঃ মুজিব বাহিনী: (পর্ব-২)

মুজিব বাহিনী (পর্ব-৩)

প্রকাশিত সময় ১১:০৮:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ নভেম্বর ২০২১

বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান
বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান

‘স্যামস বয়েজ’: ভারতের গোপনে লালিত সংগঠন
১৯৭১ সালের মে মাসের শুরুতে ‘সানী ভিলা’র সেই বৈঠকে মে.জেনারেল উবানকে তাঁদের পরিকল্পনা জানান চার নেতা। উবান তাঁর বইয়ে লিখেছেন, পরিকল্পনাটি তাঁর খুবই পছন্দ হয়। মুজির বাহিনীর গঠন এবং প্রশিক্ষণের ব্যাপারটা পুরোটাই গোপনে ব্যবস্থা করা হয়; আর এ ব্যাপারে ভারতীয় সেনাপ্রধান এবং ওয়ার কাউন্সিল হেড জেনারেল স্যাম মানেকশ ছাড়া আর কেউই কিছু জানতেন না। এ কারণে মুজির বাহিনীকে ‘স্যামস বয়েজ’ নামে উল্লেখ করতো ভারতীয় বাহিনী। উবান জানাচ্ছেন, পরে তাজউদ্দিনকে মানেকশ সরাসরি বলেছেন যে সেনাবাহিনীর বিশেষ দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য মানেকশ নিজেই গড়ে তুলেছেন এই বাহিনী। ভারতে নির্বাসিত তিব্বতিদের নিয়ে গড়া স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সফল রূপকার উবানকে দায়িত্বটা দেওয়া হয় ওপর মহল থেকে। ‘র’প্রধাণ আরএন কাও, যিনি একই সঙ্গে ভারতীয় কেবিনেট সেক্রেটারিয়েটের সচিব ছিলেন, উবান মুজিব বাহিনী বিষয়ে সরাসরি শুধু তাঁকেই রিপোর্ট করতেন।

২৯ মে মোট ২৫০ জনের প্রথম দলটি দেরাদুনের দেড় কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি শহর তানদুয়াতে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে। এদিকে মেঘালয়ের হাফলংয়ে আরেকটি ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়, কিন্তু একটি ব্যাচ সেখানে ট্রেনিং নেওয়ার পর পরই সেই ক্যাম্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণে ভারতীয় সেনা বাহিনীর কর্মকর্তারা। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মেজর মালহোত্রা যিনি পরে রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষকেরও দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যেকার আটজনকে বাছাই করা হয় পরবর্তী ব্যাচের প্রশিক্ষক হিসাবে – হাসানুল হক ইনু, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, আফম মাহবুবুল হক, রফিকুজ্জামান, মাসুদ আহমেদ রুমী (প্রয়াত ক্রীড়া সাংবাদিক), সৈয়দ আহমদ ফারুক, তৌফিক আহমেদ ও মোহনলাল সোম। পরে প্রশিক্ষকের সংখ্যা বাড়িয়ে ৫২ জন করা হয়, ২০ নভেম্বর ১৯৭১ মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং বন্ধ করে দেওয়া হয়। যে পর্যন্ত ১০ হাজার মুজিব বাহিনী সদস্য প্রশিক্ষণ নেন। নেতাদের মধ্যে আব্দুর রাজ্জাকই প্রথম ব্যাচের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ সামরিক ট্রেনিং নেন, বাকিটা নেন প্রাথমিক প্রশিক্ষণ।

মুজিব বাহিনীর সাংগঠনিক রূপরেখা
বাংলাদেশকে মোট ৪টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। মুজিব বাহিনীর অপারেশনের জন্য। উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টর কমান্ডার ছিলেন সিরাজুল আলম খান, যাঁর আওতায় ছিল বৃহত্তর রংপুর, রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর। তাঁর সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনি। দক্ষিণাঞ্চলীয় সেক্টর (বৃহত্তর খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালি) ছিল তোফায়েল আহমেদের অধীনে, সহঅধিনায়ক ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ। শেখ ফজলুল হক মনির কমান্ডে ছিল পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টর (বৃহত্তর ঢাকার কিছু অংশ, বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালি, সিলেট। তাঁর সহঅধিনায়ক ছিলেন আসম আ. রব ও মাখন। আব্দুর রাজ্জাকের দায়িত্বে ছিল কেন্দ্রীয় সেক্টর যা গঠিত ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও ঢাকার বাকি অংশ নিয়ে। তাঁর সহঅধিনায়ক ছিলেন সৈয়দ আহমদ। চার নেতা ছিলেন জেনারেল সমমর্যাদার, তাঁদের যাতায়াতের জন্য হেলিকপ্টার বরাদ্দ ছিল, প্রত্যেক সেক্টরের জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ ছিল যা বন্টনের দায়িত্ব ছিল নেতাদের হাতে।

আলাদা ওয়্যারলেস সিস্টেম, আলাদা কোডের অধিনে মুজিব বাহিনী ছিল আদতে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের একদল যোদ্ধা। পাঁচ বছর মেয়াদী একটি পরিকল্পনা নিয়ে এই বাহিনী গঠন করা হয়। প্রাথমিক পরিকল্পনায় ছিল দেশের মধ্যে ছোট ছোট পকেট তৈরি করা, সেসব পকেটে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল বানানো। প্রতিটি থানায় (বর্তমানে উপজেলা) কমপক্ষে পাঁচজনের একটি সেল তৈরি করা হতো যার দায়িত্বে থাকতেন একজন সংগঠক ও তাঁর সহকারী। আশ্রয়স্থলের জন্য একজন নেতা থাকতেন এং বাকি দুজনের দায়িত্ব ছিল বাহকের। এরপর সেখানে যোদ্ধারা আশ্রয় নিয়ে লড়াই শুরু করবেন, প্রতিবিপ্লবী ও পাকবাহিনীর দালালদের হত্যা করবেন। আর মুক্তাঞ্চল তৈরি হবার পর তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে মুজিববাদের ভিত্তিতে।

মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতিত্ব ছিনতাই: বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া
সে সময় কলকাতা থেকে আওয়ামী লীগের প্রচারপত্র হিসেবে বের হতো সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’। কিন্তু আলোড়ন তুলল শেখ মনি সম্পাদিত সাপ্তাহিক বাংলার বাণী। একদল তরুণ সাংবাদিকের এই পত্রিকাটি অল্প সময়ে গ্রহণযোগ্যতা পেল পশ্চিম বঙ্গের সাংবাদিক মহলে।

বাংলার বাণীর খবর প্রকাশের ধরনে রুষ্ট হলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানী। বাংলার বাণীতে বাংলাদেশের যেকোনো রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের যেসব খবর ছাপা হতো তাতে মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিবাহিনী না লিখে মুজিব বাহিনী লেখা হতো। মুক্তিবাহিনী সদর দফতরে জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলামের ভাষ্যে: বাংলার বাণীতে যেদিন প্রথম মুক্তিবাহিনীর স্থলে মুজিব বাহিনী লেখা হলো, সেদিন কর্ণেল ওসমানী আমাকে ডেকে নিয়ে খুবই কড়া ভাষায় আমাকে বললেন, নজরুল সাহেব, মুজিব বাহিনী কি? ওসব কারা লিখছে? কেন লিখছে? আপনি এসব তদন্ড করে জানাবেন আর বলবেন যেন ভবিষ্যতে মুজিব বাহিনী আর না লেখা হয়। এতে করে আমাদের নিয়মিত বাহিনীতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।

দিন কয়েক পর নজরুল জানালেন তাঁর তদন্তের ফল। ‘বললাম, স্যার এই পত্রিকা শেখ ফজলুল হক মনি সাহেবে। এ কথা বলতেই ওসমানী সাহেবের উন্নত গোঁফগুলো নুয়ে গেল। এরপর হু বলে একটা গম্ভীর ধরনের শ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে। খানিকপর তাঁর মুখ থেকে বেরোল: সবকিছুতে একটা ডিসিপ্লিন আছে। এখানে আমরা রং-তামাশা করতে আসিনি। বিদেশের মাটিতে আমরা যে বিশৃঙ্খলা ও অনৈক্য দেখাচ্ছি তা জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়, নজরুল সাহেব। এতে আমাদের সম্পর্কে এদের ধারনা খুব খারাপ হবে। আর আমাদের এই অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলার কথা কি মনে করেন কলকাতার এই চার দেয়ালের ভেতর বন্দী থাকবে? শত্রুপক্ষ এর সুবিধা নিশ্চয়ই নেবে। আপনি-আমি এখানে বসে নানা বাহিনী গঠন করি, আর যে ছেলেটি বাংলাদেশের পথে-জঙ্গলে কিংবা নদীতে ট্রিগারে আঙ্গুল লাগিয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে শত্রু হননের অপেক্ষায় বসে রয়েছে তার কথা কি আমরা চিন্তা করি? বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আনব।’ (চলবে…..)

লেখা: বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মতিউর রহমান, ঈশ্বরদী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, কলামিষ্ট।

সহায়তা/উৎস: অমি রহমান পিয়াল, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, ব্লগার, বর্তমানে প্রবাসী।

আরও পড়ুনঃ মুজিব বাহিনী: পর্ব-১

আরও পড়ুনঃ মুজিব বাহিনী: (পর্ব-২)