পথশিশুদের আশার আলো ছড়াচ্ছে ঈশ্বরদীর “প্রতিশ্রুতি পথের পাঠশালা”
- প্রকাশিত সময় ০১:২৪:০৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ জানুয়ারী ২০২২
- / 191
ঈশ্বরদী সংবাদদাতাঃ সকাল হলেই একদল পথশিশু শহরে বিভিন্ন জায়গায় ভিক্ষায় করতো। ঈশ্বরদী শহরের বাজার, ষ্টেশনে বেশভুষায় নজরকারা মানুষদের দেখলেই ভিক্ষার জন্য পা জড়িয়ে ধরত। এদের কেউ কেউ শহরের আশেপাশের ফুটপাতে প্লাষ্টিক, বোতল, পলিথিন কুড়াত। আবার কেউ ওষুধের দোকানে, কেউ শহরের রাস্তায় বাবা-মার সাথে ঝাড়ু দেওয়া, গ্যারেজ ও দোকানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতো। আবার কেউবা মাদকের নেশায় আসক্ত ছিলো।
বস্তি, রেলওয়ে ষ্টেশন, দারিদ্র পরিবার, ছিন্নমূল, সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুরা এখন কেউ ভিক্ষা করে না, পলিথিন কুড়ানো বা বাদাম-চকলেট ফেরি করে না, তারা এখন সবাই বই-খাতা-কলম নিয়ে আসে পড়ালেখা করার জন্য।
শহরের রেলওয়ে ষ্টেশনের পাশে উন্মুক্ত একটি জায়গায় ভাসমান পাঠশালা গড়ে তুলেছে ঈশ্বরদীর একটি মানবিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনের পাশে একটি উন্মুক্ত জায়গায় সমাজের অবহেলিত, ছিন্নমূল, দারিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এসব পথশিশুদের আলোর ঠিকানা হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী মানবিক সংগঠন প্রতিশ্রুতি পথের পাঠশালা“তে।
“প্রতিশ্রুতি পথের পাঠশালা“ এর উদ্যোক্তা ঈশ্বরদী সরকারী কলেজের স্নাতক ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী আসাদুজ্জামান রকিব। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির ৪৫ জন সদস্যের মধ্যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ১৮ জন শিক্ষার্থী।
তারা এসব পথশিশুদের পাঠদানের পাশাপাশি বিনামূল্যে দিচ্ছেন বই-খাতা, কলম, পেন্সিল। পড়াশোনায় উৎসাহিত করতে শিশুদের প্রতিদিন দিচ্ছেন নিজেদের অর্থায়নে হরেক রকমের নাস্তা। উৎসাহ উদ্দীপনা জাগাতে নাচ-গান, খেলাধুলা সহ বিভিন্ন বিনোদন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন তারা।
তাদের উদ্যোগে সাড়া দিয়ে ইতিমধ্যে ৫-৬ জন ঝরে পড়া শিশুকে ঈশ্বরদীর বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছেন। অনেক পথ শিশু মাদক ছেড়ে এখন পড়ালেখায় উৎসাহিত হয়েছেন। অনেক পথশিশুই এখন জীবনে ভালো কিছুর প্রত্যাশা করছে।
সোমবার বিকালে ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনে গেলে দেখা যায়, অনেক শিশুকে পাঠদান করচ্ছেন “প্রতিশ্রুতি পথের পাঠশালা“ এর সেচ্ছাসেবী শিক্ষকবৃন্দ। সেখানে প্রতিবেদকের উপস্থিতি পেয়ে হাস্য উজ্জল ছোট বাচ্চারা আনন্দে মেতে ওঠে। এরপর “প্রতিশ্রুতি পথের পাঠশালা“ এর উদ্যোক্তা আসাদুজ্জামান রকিবের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে উঠে আসে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির শুরুর গল্প।
ঈশ্বরদী সাঁড়া ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে জম্মগ্রহন করেন আসাদুজ্জামান রকিব। বাবা সেনা সদস্য হিসেবে ঈশ্বরদী মিলিটারি ফার্মে কর্মরত আছেন। স্কুলজীবন থেকেই শীতবস্ত্র সংগ্রহ করে দুঃস্থদের মাঝে বিতরণ, রক্তদানের মতো মানবিক কাজে সামনের সারিতে ছিলেন। এসএসসি পাশের পর ভর্তি হন সরকারি সাঁড়া মাড়োয়ারি কলেজে।
ছোট বেলা থেকেই উদ্যামী ছেলেটি বিভিন্ন সংগঠনের সাথে মানবিক কাজে পাশে থাকতেন। ইচ্ছে ছিলো দেশের সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের জন্য কিছু করা। সেই ইচ্ছা থেকেই ২০১৭ সালে ১ ফেব্রুয়ারি মাসে ৪ জন সহযোগীকে নিয়ে নিজেই “প্রতিশ্রুতি স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়ন মূলক সংস্থা” নামে সংগঠনের কাজ শুরু করেন। সংগঠনটি রক্তদান কর্মসুচি, ছিন্নমূল মানুষদের আহার যোগানো, শীতবস্ত্র বিতরণ সহ বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে শুরু করে এখনও কাজ করে যাচ্ছে।
তাদের সেবামূলক কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে সংগঠনটিতে অনেক তরুণ-তরুণী স্বেচ্ছায় সংগঠনটির সাথে কাজ করতে ইচ্ছুক হয়। বর্তমানে সংগঠনটিতে ৪৫ জন তরুণ-তরুণী কাজ করছেন বলে জানা যায়।
রকিব আরও জানান, আমরা অনেকদিন ধরে রক্তদান, দারিদ্র ও অসহায় মানুষদের ক্ষুধা নিবারনের জন্য আহার যোগানো, শীতে গরম পোষাক, অসুস্থ্য ব্যক্তিদের সহযোগিতা করে আসছি। আজ থেকে কয়েক মাস আগে চিন্তা করি নতুন কিছু করতে হবে, তাই নিজের চিন্তানুযায়ী অসহায় ছিন্নমূল পথশিশুদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করি। পথশিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করলে প্রথমে অনেকেই উৎসাহ দেন আবার অনেকেই বিরূপ মন্তব্য করেন। তাও নিজেকে দমিয়ে রাখিনি, সাধ্যমত চেষ্টায় সংগঠনের কয়েক জনকে নিয়ে আজ ৪ মাস ধরে নিজেদের অর্থায়নে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। প্রথমে ৫-৬ জন শিশুকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন প্রায় ৪৫ জন পথশিশু আমাদের এখানে শিক্ষা গ্রহন করছেন। সংগঠনের সকল সদস্যের সহযোগীতায় আমাকে এই কার্যক্রম চালিয়র যাওয়ার সাহস যুগিয়েছে।
রকিব বলেন, বিগত দুই মাস যাবৎ প্রায় ৪৫ জন শিশুকে এখানে পাঠদান করানো হচ্ছে। শুরুতেই অর্থনৈতিক সমস্যা হচ্ছিলো, পরে পথশিশুদের ভাসমান পাঠশালার জন্য সংগঠনের অন্য সদস্যদের সাথে আলোচনা করলাম। প্রথমে কয়েকজন সদস্য তাদের প্রতিদিনের হাত খরচের টাকা থেকে কিছু টাকা এই পাঠশালার শিশুদের জন্য বরাদ্দ করতো। এভাবেই সাহস নিয়ে কাজ চালিয়ে যায় আমরা, পরে সংগঠনের অনেকেই প্রতিদিনের হাত খরচের টাকা থেকে কিছু টাকা দিয়ে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে শুরু করে। এভাবেই আজ ৪ মাস ধরে আমরা পাঠশালার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।
“প্রতিশ্রুতি স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়নমূলক সংস্থা” এর সকল সদস্যই ছাত্র। বেশিরভাগ সদস্য নিয়মিত চাঁদা দিতে পারে না, অভিজ্ঞতাও নেই কারও, পাঠশালা চালাতে নানা উপকরণ দরকার, সংগঠনের সদস্যদের থেকে টাকা তুলেই ছিন্নমূল পথশিশুদের শিক্ষা পরিচালনা উপকরণসমূহ কিনেছি।
সোমবার ৫ জানুয়ারি বিকালে পথশিশুদের জন্য “প্রতিশ্রুতি পথের পাঠশালা” তে গিয়ে দেখা যায়, ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনের পাশে একটি উন্মুক্ত জায়গায় হোয়াইট বোর্ডে মার্কার কলমে ছবি এঁকে পাঠদান করাচ্ছেন রকিব। তাঁকে সহযোগিতা করছেন অন্য সংগঠনের অন্য সেচ্ছাসেবী শিক্ষকবৃন্দ। পাঠশালার পাঠদান কৌশল বেশ ভিন্ন ও বৈচিত্র্যময়। শিশুদের বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয় করানো হচ্ছে বিভিন্ন গল্প, ছবি এঁকে এবং অভিনয় করে।
আসাদুজ্জামান রকিব জানান, পাঠশালায় বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৫ জন হলেও নিয়মিত উপস্থিত থাকে গড়ে ২৫-৩০ জন। সপ্তাহে প্রতিদিন দুপুর ৩টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত পাঠদান করানো হয়। অনেকে বিভিন্ন সমস্যার কারনে নিয়মিত উপস্থিত হতে পারে না। সংগঠনের সদস্যবৃন্দ শিশুদের নিয়ন্ত্রণসহ নাস্তা বিতরণে সহযোগিতা করে।
রকিব বলেন, আমরা নিজেদের সদস্যদের ছোট অর্থায়নে মানবিক কাজ করে থাকি, এছাড়া আমাদের অন্য কোন দাতা নেই। তবে সমাজের সহৃদবান বিত্তবান শ্রেনীর সহযোগিতা পেলে আমরা আরও ভালো কিছু করতে পারবো বলে মনে করি। অসহায় ছিন্নমুল এসব পথশিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা ছাড়া আরও কিছু করতে পারলে ভালো লাগবে। এসময় তিনি সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনা করেন।
তিনি ছিন্নমূল শিশুদের সম্পর্কে জানান, রেলওয়ে জংশনে পাশে থাকা কয়েকজন পথশিশু সারাদিন ভিক্ষা করতো, এসব শিশুকে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে ফিরিয়েছেন পাঠশালার উদ্যোক্তারা।
উদ্যোক্তারা জানান, শহরের কলোনি এলাকার আসেপাসে দরিদ্র পরিবার থেকে বেড়ে ওঠা নাজনীন আক্তার জোত্যি, হৃদয় কে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি। পাপ্পু, জিম আগে কাজ করত তাদেরকে আমরা স্কুলে ফিরিয়েছি।
ঈশ্বরদী সরকারী কলেজের ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, একঝাক তরুনরা এরকম সাহসী উদ্যোগ গ্রহন করেছে বলে “প্রতিশ্রুতি পথের পাঠশালা” এর সকল সদস্যকে আমি ধন্যবাদ এবং সাধুবাদ জানায়। এবং এধরনের সংগঠন সমাজের প্রত্যেক শ্রেনীর মানুষের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে আমি মনে করি। পথশিশুদের জন্য এরকম উদ্যোগ আমাদের জাতিকে আলোর পথ দেখাবে, পথশিশুরা এগিয়ে যাবে এবং ভবিষতে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে মূখ্য ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি এধরনের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে সহযোগীতা করার জন্য সমাজের সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।