ঢাকা ০৮:৪১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞপ্তি :
সারাদেশের জেলা উপোজেলা পর্যায়ে দৈনিক স্বতঃকণ্ঠে সংবাদকর্মী নিয়োগ চলছে । আগ্রহী প্রার্থীগন জীবন বৃত্তান্ত ইমেইল করুন shatakantha.info@gmail.com // দৈনিক স্বতঃকণ্ঠ অনলাইন ও প্রিন্ট পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন ০১৭১১-৩৩৩৮১১, ০১৭৪৪-১২৪৮১৪

করোনাভাইরাস পরীক্ষায় জালিয়াতি : জেকেজির আরিফুল, সাবরিনাসহ আট আসামির ১১ বছর করে সাজা

বার্তাকক্ষ
  • প্রকাশিত সময় ১১:৫১:৩৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই ২০২২
  • / 90

রায়ের দিন আদালতে ডা. সাবরিনা চৌধুরী


বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১১:৫১ অপরাহ্ন, ১৯ জুলাই ২০২২


করোনাভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির দায়ে জেকেজি হেলথকেয়ারের সিইও আরিফুল হক চৌধুরী, তার স্ত্রী ডা. সাবরিনা চৌধুরীসহ আট আসামির সবাইকে ১১ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন মঙ্গলবার আসামিদের উপস্থিতিতে আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, “এ মামলায় একই অভিপ্রায় নিয়ে সকল আসামি ঘটনা ঘটিয়েছে। তাই সকলেই একইভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে।”

মহামারীর প্রথম বছর জেকেজির জালিয়াতির ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে এলে সারা দেশে আলোড়ন তৈরি হয়। এর সঙ্গে সরকারি চাকরিতে থাকা চিকিৎসক সাবরিনার যোগসাজশ বিষয়টিকে নতুন মাত্রা দেয়।

রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের চাকরিচ্যুত চিকিৎসক ডা. সাবরিনা বলেন, “আমি চেয়ারম্যান ছিলাম না, এই সাজা কীভাবে হল? আপিলের কথা তো পরে। কী হবে বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু এতটা হবে বুঝতে পারিনি।”

সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফুল ছাড়া মামলার বাকি ছয় আসামি হলেন- আরিফুলের বোন জেবুন্নেছা রিমা, সাবেক কর্মচারী হুমায়ুন কবির হিমু ও তার স্ত্রী তানজিলা পাটোয়ারী, জেকেজির কোঅর্ডিনেটর আবু সাঈদ চৌধুরী, জেকেজির কর্মচারী বিপুল দাস ও শফিকুল ইসলাম রোমিও।

বিচারক তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, কোভিড-১৯ মহামারী রাষ্ট্র এবং জনগণ সকলের জন্যই ছিল একটি ‘দুর্যোগ’।

“সেই দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকার কিছু হাসপাতালকে বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষার দায়িত্ব প্রদান করে। যেসব শর্তে করোনা পরীক্ষার দায়িত্ব পেয়েছে, জেকেজি হেলথ কেয়ার সেসব শর্ত লঙ্ঘন করে লাভবান হতে প্রতারণা, জাল রিপোর্ট তৈরি এবং জাল প্রত্যয়নপত্রকে খাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে দণ্ডবিধির ৪২০, ৪৬৬ ও ৪৭১ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।”

রায়ের দিন আদালতে জেকেজি হেলথকেয়ারের সিইও আরিফুল হক চৌধুরীরায়ের দিন আদালতে জেকেজি হেলথকেয়ারের সিইও আরিফুল হক চৌধুরীএই রায়কে স্বাগত জানালেও আরও বেশি সাজা না হওয়ায় আপিল করার ভাবনার কথা বললেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর আজাদ রহমান।

রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “যে সাজা হয়েছে, তাতে কয়েকটি অভিযোগে আসামিরা খালাস পেয়েছেন। যেসব ধারায় দণ্ড হয়েছে, তাতে আরও বেশি সাজা হতে পারত। খালাস বা অপর্যাপ্ত দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, তা পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা মনে করছেন, এই রায়ে তাদের মক্কেলরা ন্যায়বিচার থেকে ‘বঞ্চিত হয়েছেন’।

আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, রায়ে আদালত কোনো পর্যবেক্ষণ দেননি, তবে সাক্ষ্য প্রমাণে এসেছে- জেকেজি ‘বৈধ প্রতিষ্ঠান’।

“এখন বলছে যে আমরা জাল সার্টিফিকেট দিয়েছি। বাদীসহ ভিকটিম যাদেরকে আমরা চিকিৎসা দিয়েছি, তারা কেউ তাদের কোনো সার্টিফিকেটের কপি আদালতে দাখিল করেননি। তারা ইমেইলের মাধ্যমেও কপি দেননি। তদন্তকারী কর্মকর্তা কিছু কাগজ নিয়ে এসে বলছে এগুলো নাকি ফটোকপি। ফটোকপি তো সাক্ষ্য আইনে গ্রহণযোগ্য নয়।

“এখানে কোনো প্রমাণ না থাকার পরও বিজ্ঞ আদালত আমাদের সাজা দিয়েছেন। আমরা মনে করি আমাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে, অবিচার করা হয়েছে এবং একটা পক্ষকে খুশি করা হয়েছে।”

মামলা বৃত্তান্ত
দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ২০২০ সালের মার্চে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করে পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহের দায়িত্ব নিয়েছিল ওভাল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথকেয়ার।

কিন্তু জুনের শেষ দিকে অভিযোগ আসে, সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে বুকিং বিডি ও হেলথকেয়ার নামে দুটি সাইটের মাধ্যমে টাকা নিচ্ছিল জেকেজি। নমুনা পরীক্ষা না করে রোগীদের ভুয়া সনদও তারা দিচ্ছিল।

রাজধানীর কল্যাণপুরের কামাল হোসেন নামে এক ব্যক্তির অভিযোগের সত্যতা পেয়ে গত ২২ জুন জেকেজি হেলথ কেয়ারের সাবেক গ্রাফিক ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরু ও তার স্ত্রী তানজীলাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

পরে তাদের কম্পিউটার থেকে চারজন প্রবাসীরসহ ৪৩ জনের নামে তৈরি করা করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া সনদ পাওয়া যায়।

পরদিন কামাল হোসেন বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করেন ওই দুইজনের বিরুদ্ধে। সরকারি নাম ব্যবহার করে টাকা আত্মসাৎ, কাজে অবহেলার মাধ্যমে জীবন বিপন্নকারী রোগের সংক্রামণ বিস্তারের ঝুঁকি তৈরি, করোনাভাইরাসের সনদ জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয় সেখানে।

এরকম বুথে বসিয়ে করোনাভাইরাস শনাক্তের নমুনা সংগ্রহ করত জেকেজি হেলথকেয়ারএরকম বুথে বসিয়ে করোনাভাইরাস শনাক্তের নমুনা সংগ্রহ করত জেকেজি হেলথকেয়ারহুমায়ুন ও তার স্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরে তেজগাঁও থানা পুলিশ জেকেজির সিইও আরিফুল চৌধুরী, তার বোন জেবুন্নেছাসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে।

পরে ১২ জুলাই জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেকেজির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

প্রায় দুই মাস তদন্ত শেষে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী ১৩ আগাস্ট অভিযোগপত্র দেন। নমুনা পরীক্ষা না করেই ২৭ হাজার মানুষকে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় সেখানে।

অভিযোগপত্রে সাবরিনা ও আরিফকে জালিয়াতির ‘হোতা’ বলে উল্লেখ করা হয়। আর বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ওই জালিয়াতিতে ‘সহযোগিতা’ করেছেন।

ওই বছর ২০ অগাস্ট দণ্ডবিধির ১৭০/২৬৯/৪২০/৪০৬/৪৬৬/৪৬৫/৪৭১/৩৪ ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার মহানগর হাকিম সারাফুজ্জামান আনছারী।

গত ২০ এপ্রিল এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। অভিযোগপত্রের ৪০ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৬ জন বিভিন্ন সময়ে সাক্ষ্য দেন। পরে ১১ মে আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন।

রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত ২৯ জুন মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে।

sabrina-ariful
ডা. সাবরিনা আরিফ ও আরিফুল চৌধুরী

কোন ধারায় কী সাজা
এ মামলায় দণ্ডবিধির ১৭০ ধারায় সরকারি কর্মচারীর ভুয়া পরিচয় ব্যবহার, ২৬৯ ধারায় বিপজ্জনক রোগের সংক্রমণ ছড়াতে পারে জেনেও অবহেলা, ৪০৬ ধারায় অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ, ৪২০ ধারায় প্রতারণা, ৪৬৫ ধারায় জালিয়াতি, ৪৬৬ ধারায় সরকারি নথি জাল, ৪৭১ ধারায় জাল দলিলকে খাঁটি হিসেবে দেখানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল।

এর মধ্যে ৪২০ ধারায় আসামিদের তিন বছর করে কারাদণ্ড এবং তিন হাজার টাকা করে জরিমানা করেছে আদালত। জরিমানা অনাদায় আরও তিন মাস কারাভোগ করতে হবে তাদের।

দণ্ডবিধির ৪৬৬ ধারায় আট আসামির প্রত্যেককে চার বছরের কারাদণ্ড এবং চার হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায় আরও চার মাসের সাজা দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া দণ্ডবিধি ৪৭১ ধারায় চার বছর করে কারাদণ্ড এবং চার হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও চার মাসের সাজা দেওয়া হয়েছে রায়ে।

তিন ধারার সাজা পর্যায়ক্রমে কার্যকর হবে; ফলে তাদের সবাইকে ১১ বছর করে জেলে কাটাতে হবে। এ সাজা থেকে হাজতবাসের সময় বাদ যাবে।

দণ্ডবিধির ১৭০, ২৬৯, ৪০৬ ও ৪৬৫ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এসব ধারায় আসামিদের খালাস দেওয়া হয়েছে রায়ে।

আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, “এই মামলায় তিনটি ধারায় আলাদাভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত পৃথক অভিযোগে সাজা হলে সবচেয়ে বেশি মেয়াদের দণ্ড ভোগ করতে হয়। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে সাজাগুলো একটার পর একটা চলবে, ফলে তাদের ১১ বছর সাজা ভোগ করতে হবে।

“এ ধরনের রায় আমরা আগে কখনো দেখিনি। আমরা মনে করি, উচ্চ আদালতে গেলে এই বিষয়টার সমাধান হয়ে যাবে।”

 


 আরও পড়ুনঃ

 আরও পড়ুনঃ


করোনাভাইরাস পরীক্ষায় জালিয়াতি : জেকেজির আরিফুল, সাবরিনাসহ আট আসামির ১১ বছর করে সাজা

প্রকাশিত সময় ১১:৫১:৩৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই ২০২২

রায়ের দিন আদালতে ডা. সাবরিনা চৌধুরী


বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১১:৫১ অপরাহ্ন, ১৯ জুলাই ২০২২


করোনাভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির দায়ে জেকেজি হেলথকেয়ারের সিইও আরিফুল হক চৌধুরী, তার স্ত্রী ডা. সাবরিনা চৌধুরীসহ আট আসামির সবাইকে ১১ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন মঙ্গলবার আসামিদের উপস্থিতিতে আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, “এ মামলায় একই অভিপ্রায় নিয়ে সকল আসামি ঘটনা ঘটিয়েছে। তাই সকলেই একইভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে।”

মহামারীর প্রথম বছর জেকেজির জালিয়াতির ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে এলে সারা দেশে আলোড়ন তৈরি হয়। এর সঙ্গে সরকারি চাকরিতে থাকা চিকিৎসক সাবরিনার যোগসাজশ বিষয়টিকে নতুন মাত্রা দেয়।

রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের চাকরিচ্যুত চিকিৎসক ডা. সাবরিনা বলেন, “আমি চেয়ারম্যান ছিলাম না, এই সাজা কীভাবে হল? আপিলের কথা তো পরে। কী হবে বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু এতটা হবে বুঝতে পারিনি।”

সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফুল ছাড়া মামলার বাকি ছয় আসামি হলেন- আরিফুলের বোন জেবুন্নেছা রিমা, সাবেক কর্মচারী হুমায়ুন কবির হিমু ও তার স্ত্রী তানজিলা পাটোয়ারী, জেকেজির কোঅর্ডিনেটর আবু সাঈদ চৌধুরী, জেকেজির কর্মচারী বিপুল দাস ও শফিকুল ইসলাম রোমিও।

বিচারক তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, কোভিড-১৯ মহামারী রাষ্ট্র এবং জনগণ সকলের জন্যই ছিল একটি ‘দুর্যোগ’।

“সেই দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকার কিছু হাসপাতালকে বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষার দায়িত্ব প্রদান করে। যেসব শর্তে করোনা পরীক্ষার দায়িত্ব পেয়েছে, জেকেজি হেলথ কেয়ার সেসব শর্ত লঙ্ঘন করে লাভবান হতে প্রতারণা, জাল রিপোর্ট তৈরি এবং জাল প্রত্যয়নপত্রকে খাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে দণ্ডবিধির ৪২০, ৪৬৬ ও ৪৭১ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।”

রায়ের দিন আদালতে জেকেজি হেলথকেয়ারের সিইও আরিফুল হক চৌধুরীরায়ের দিন আদালতে জেকেজি হেলথকেয়ারের সিইও আরিফুল হক চৌধুরীএই রায়কে স্বাগত জানালেও আরও বেশি সাজা না হওয়ায় আপিল করার ভাবনার কথা বললেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর আজাদ রহমান।

রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “যে সাজা হয়েছে, তাতে কয়েকটি অভিযোগে আসামিরা খালাস পেয়েছেন। যেসব ধারায় দণ্ড হয়েছে, তাতে আরও বেশি সাজা হতে পারত। খালাস বা অপর্যাপ্ত দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, তা পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা মনে করছেন, এই রায়ে তাদের মক্কেলরা ন্যায়বিচার থেকে ‘বঞ্চিত হয়েছেন’।

আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, রায়ে আদালত কোনো পর্যবেক্ষণ দেননি, তবে সাক্ষ্য প্রমাণে এসেছে- জেকেজি ‘বৈধ প্রতিষ্ঠান’।

“এখন বলছে যে আমরা জাল সার্টিফিকেট দিয়েছি। বাদীসহ ভিকটিম যাদেরকে আমরা চিকিৎসা দিয়েছি, তারা কেউ তাদের কোনো সার্টিফিকেটের কপি আদালতে দাখিল করেননি। তারা ইমেইলের মাধ্যমেও কপি দেননি। তদন্তকারী কর্মকর্তা কিছু কাগজ নিয়ে এসে বলছে এগুলো নাকি ফটোকপি। ফটোকপি তো সাক্ষ্য আইনে গ্রহণযোগ্য নয়।

“এখানে কোনো প্রমাণ না থাকার পরও বিজ্ঞ আদালত আমাদের সাজা দিয়েছেন। আমরা মনে করি আমাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে, অবিচার করা হয়েছে এবং একটা পক্ষকে খুশি করা হয়েছে।”

মামলা বৃত্তান্ত
দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ২০২০ সালের মার্চে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করে পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহের দায়িত্ব নিয়েছিল ওভাল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথকেয়ার।

কিন্তু জুনের শেষ দিকে অভিযোগ আসে, সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে বুকিং বিডি ও হেলথকেয়ার নামে দুটি সাইটের মাধ্যমে টাকা নিচ্ছিল জেকেজি। নমুনা পরীক্ষা না করে রোগীদের ভুয়া সনদও তারা দিচ্ছিল।

রাজধানীর কল্যাণপুরের কামাল হোসেন নামে এক ব্যক্তির অভিযোগের সত্যতা পেয়ে গত ২২ জুন জেকেজি হেলথ কেয়ারের সাবেক গ্রাফিক ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরু ও তার স্ত্রী তানজীলাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

পরে তাদের কম্পিউটার থেকে চারজন প্রবাসীরসহ ৪৩ জনের নামে তৈরি করা করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া সনদ পাওয়া যায়।

পরদিন কামাল হোসেন বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করেন ওই দুইজনের বিরুদ্ধে। সরকারি নাম ব্যবহার করে টাকা আত্মসাৎ, কাজে অবহেলার মাধ্যমে জীবন বিপন্নকারী রোগের সংক্রামণ বিস্তারের ঝুঁকি তৈরি, করোনাভাইরাসের সনদ জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয় সেখানে।

এরকম বুথে বসিয়ে করোনাভাইরাস শনাক্তের নমুনা সংগ্রহ করত জেকেজি হেলথকেয়ারএরকম বুথে বসিয়ে করোনাভাইরাস শনাক্তের নমুনা সংগ্রহ করত জেকেজি হেলথকেয়ারহুমায়ুন ও তার স্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরে তেজগাঁও থানা পুলিশ জেকেজির সিইও আরিফুল চৌধুরী, তার বোন জেবুন্নেছাসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে।

পরে ১২ জুলাই জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেকেজির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

প্রায় দুই মাস তদন্ত শেষে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী ১৩ আগাস্ট অভিযোগপত্র দেন। নমুনা পরীক্ষা না করেই ২৭ হাজার মানুষকে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় সেখানে।

অভিযোগপত্রে সাবরিনা ও আরিফকে জালিয়াতির ‘হোতা’ বলে উল্লেখ করা হয়। আর বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ওই জালিয়াতিতে ‘সহযোগিতা’ করেছেন।

ওই বছর ২০ অগাস্ট দণ্ডবিধির ১৭০/২৬৯/৪২০/৪০৬/৪৬৬/৪৬৫/৪৭১/৩৪ ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার মহানগর হাকিম সারাফুজ্জামান আনছারী।

গত ২০ এপ্রিল এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। অভিযোগপত্রের ৪০ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৬ জন বিভিন্ন সময়ে সাক্ষ্য দেন। পরে ১১ মে আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন।

রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত ২৯ জুন মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে।

sabrina-ariful
ডা. সাবরিনা আরিফ ও আরিফুল চৌধুরী

কোন ধারায় কী সাজা
এ মামলায় দণ্ডবিধির ১৭০ ধারায় সরকারি কর্মচারীর ভুয়া পরিচয় ব্যবহার, ২৬৯ ধারায় বিপজ্জনক রোগের সংক্রমণ ছড়াতে পারে জেনেও অবহেলা, ৪০৬ ধারায় অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ, ৪২০ ধারায় প্রতারণা, ৪৬৫ ধারায় জালিয়াতি, ৪৬৬ ধারায় সরকারি নথি জাল, ৪৭১ ধারায় জাল দলিলকে খাঁটি হিসেবে দেখানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল।

এর মধ্যে ৪২০ ধারায় আসামিদের তিন বছর করে কারাদণ্ড এবং তিন হাজার টাকা করে জরিমানা করেছে আদালত। জরিমানা অনাদায় আরও তিন মাস কারাভোগ করতে হবে তাদের।

দণ্ডবিধির ৪৬৬ ধারায় আট আসামির প্রত্যেককে চার বছরের কারাদণ্ড এবং চার হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায় আরও চার মাসের সাজা দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া দণ্ডবিধি ৪৭১ ধারায় চার বছর করে কারাদণ্ড এবং চার হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও চার মাসের সাজা দেওয়া হয়েছে রায়ে।

তিন ধারার সাজা পর্যায়ক্রমে কার্যকর হবে; ফলে তাদের সবাইকে ১১ বছর করে জেলে কাটাতে হবে। এ সাজা থেকে হাজতবাসের সময় বাদ যাবে।

দণ্ডবিধির ১৭০, ২৬৯, ৪০৬ ও ৪৬৫ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এসব ধারায় আসামিদের খালাস দেওয়া হয়েছে রায়ে।

আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, “এই মামলায় তিনটি ধারায় আলাদাভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত পৃথক অভিযোগে সাজা হলে সবচেয়ে বেশি মেয়াদের দণ্ড ভোগ করতে হয়। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে সাজাগুলো একটার পর একটা চলবে, ফলে তাদের ১১ বছর সাজা ভোগ করতে হবে।

“এ ধরনের রায় আমরা আগে কখনো দেখিনি। আমরা মনে করি, উচ্চ আদালতে গেলে এই বিষয়টার সমাধান হয়ে যাবে।”

 


 আরও পড়ুনঃ

 আরও পড়ুনঃ