৫৭ বছর পর প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষককে পেয়ে অভিভূত বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক
- প্রকাশিত সময় ০৩:১৫:১০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২২
- / 106
নেই কোন আনুষ্ঠানিকতা, নেই প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি। তারপরও উচ্চ বিদ্যালঢয়টিতে সাজ সাজ রব। বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের মধ্যে এক অন্যরকম উৎসাহ। এসব শুনে বিদ্যালয়ে ছুটে আসেন বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র, এখন এসএমসি কমিটির সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান। এ সবের কারণ একজন শিক্ষক আসছেন এ উচ্চ বিদ্যালয়ে। যিনি ছিলেন এ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক।
কর্ম ও পারিবারিক সূত্রে ৫৭ বছর আগে দুরে চলে গেলেও তার ইচ্ছে ছিল তার প্রিয় বিদ্যাপীঠটিকে জীবনে অন্তত: অরেকটিবার দেখে আসা। সেই শিক্ষকের নাম হাবিবুর রহমান।
তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। তবে চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা দিয়ে। তিনি ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পাবনার চাটমোহর উপজেলার শরৎগঞ্জ টিএ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বুধবার(১৬ নভেম্বর) সকালে তিনি স্কুলে আসার পর বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি, প্রাক্তন ছাত্র, বর্তমান সময়ের শিক্ষকমন্ডলি এবং ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। তাকে সবাই পরম আবেগে বরণ করে নেন। এসবের পাশাপাশি ছিলো স্মৃতিচারণ। সর্বোপরি এটি হয়ে উঠেছিলো একটি মিলন মেলা। সে মেলায় ভালবাসায় অভিূত হন সাবেক প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান। তিনি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কুড়ালিয়া গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন এবং তিনি এখন রাজশাহীতে বসবাস করেন। তার পিতার নাম আলহাজ্ব জব্বার আলী আকন্দ (মৃত )।
জানা গেছে, ১৯৬৪ সালে পাবনা জেলার সে সময়ে একেবারে অজ পাড়া গাঁ শরৎগঞ্জে টিএ উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এটাকে আপ্রগ্রেড স্কুল বলা হত। এখন ৭৮ বছর বয়সী সে সময়ের যুবক হাবিববুর রহমান প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। তার কর্মদক্ষতা ও প্রচেষ্টায় এক বছরের মধ্যে বিদ্যালয়টি পূর্ণাঙ্গ উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। তার প্রচেষ্টায় গড়া প্রতিষ্ঠান ছেড়ে তিনি পারিবারিক কারণে শিক্ষকতা ছেড়ে ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৯৬৬ সালে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্থানে যোগ দেন; তিনি ২০০১ সালে যুগ্ম পরিচালক হিসেবে অবসর নেন।
এদিকে আপন গতিতে চলতে থাকে বিদ্যালয়টি। অন্য চাকরি জীবনে গিয়ে তিনিও ব্যাপক সাফল্য পান। একজন উচ্চ পদস্থ ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে তিনি অবসর নেন। তবে তার হৃদয়ে সব সময় কোকিল হয়ে ডেকে যেত শরৎগঞ্জে টিএ উচ্চ বিদ্যালয়। কতবার আসতে চেয়েছেন কিন্তু পেশাগত ও পারিবারিক নানা ব্যস্ততায় যাওয়া হয়নি। এবার তিনি মনস্থির করেন যেভাবেই হোক তিনি দেখে আসবেন তার হাতে গড়া সেই উচ্চ বিদ্যালয়টি কেমন আছে!
বৃহস্পতিবার তিনি সেই উচ্চ বিদ্যালয়ে যান। এখন কর্মরতরা তার না শুনলেও এর আগে দেখেননি কোনদিন। তার অভিভূত হয়ে পড়েন। সারা বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে খবর চলে যায় এ হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক আসছেন। তিনি বিদ্যালয়ে পৌছানোর পর রীতিমত হৈচৈ পড়ে যায়। খবর পান চাটমোহর উপজেলা চেয়ারম্যান এবং এ স্কুলের এসএমসি সভাপতি আব্দুল হামিদ মাস্টার। তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রেখে ছুটে আসেন। তিনি এসে জানান, তিনিও এ স্কুলের সাবেক ছাত্র। শুধু সাবেক ছাত্র নন তিনি হাবিবুরর রহমানেরও ছাত্র ছিলেন। এ সময় এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
সাবেক শিক্ষক হাবিবুর রহমান বিদ্যালয়টিতে পরশ বুলিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি সব শ্রেণিকক্ষ পরিদর্শন করেন। মত বিণিময় করেন এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সাথে। তিনি তাদের জন্য নানা
উপদেশ দেন। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আর্থিক দুরবস্থা বা ভৌগলিক অবস্থা কোন বাধা নয় যদি অধম্য ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা থাকে। তিনি নিজের উদাহরণ দিয়েই বেলন, তিনি নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম নিয়েও সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তার ছেলে-মেয়েদের সবাই স্বনামখ্যাত চিকিৎসক কিম্বা প্রকৌশলী। তার উদ্দীপনামূলক কথায় ছাত্র-ছাত্রীরা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তাদরে উদ্দীপনার কথ াজানান। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলানোর কথা বলেন।
৮ম শ্রেণির ছাত্রী মারিয়া মিলি জানান, এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক আসায় তারা খুব আনন্দিত। তার কিছু উপদেশ তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে বলে তার বিশ্বাস। ৯ম শ্রেণির ছাত্র রনি ইসলাম জানান, বহু বছর আগের প্রাক্তন স্যার এসেছেন ্রপানেল টানে। এতে তারা ধন্য বলে জানান। তিনি জানান, স্যারের উপদেশগুলো মেনে বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন আরো বেড়ে গেছে। তারা খুব আনন্দিত ও উৎসাহিত বলে জানান।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পাবনা শহর থেকে প্রায় ২০ কি.মি, দুরের এ স্কুলটি একটি প্রত্যন্ত জনপদে অবস্থিত। পাবনার আটঘরিয়া, চাটমোহর, ফরিদপুর উপজেলার সীমানা এলাকায় চিকনাই নদীর পাড়ে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত। এখন সড়ক যোগাযোগ ভাল হলেও আগে শুধু বিল-বাওড় দিয়ে বোঝাই ছিল। এখন বিলের উপর দিয়ে রাস্তাঘাট হয়ে এলাকার চেহারা বদলে গেছে। ৬০ এর দশকে এখানে উচ্চ বিদ্যালয়ের কথা ভাবা যায়! অথচ এ কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন দূরদর্শী হাবিববুর রহমান স্যার।
হাবিবুর হমান জানান, তিনি সাংসারিক কারণে শিক্ষকতা পেশো ছেড়ে অন্য পেশায় গেলেও তিনি ভুলতে পারেননি তার শিক্ষকত জীবনের কথা। এজন্য বহুবার তিরি প্রাণের টানে এ বিদ্যালয়ে আসতে চেয়েছিলে। কিন্ত নানা ব্যস্ততায় আর হয়ে ওঠেনি। তবে এবার তিনি পাবনায় আসেন এ বিদ্যালয়ে হাজির হবেন এ প্রতিজ্ঞ নিয়েই।
তিনি জানান, বিদ্যালয়ে এসে সবার এমন ভালবাসায় তিনি মুগ্ধ। অন্য পেশাতেও তিনি সৎ জীবন যাপন করেছেন জানিয়ে বলেন, শিক্ষকতার মত আনন্দ অন্য চাকরিতে তিনি পাননি। তিনি জানান, ৫৭ বছর পর বিদ্যালয়ে এসে তিনি যেন তার সেই আগের দিনে ফিরে গেছেন। এখন সব ক্লাস ঘুরে মনে হয়েছে মুখগুেলো যেন চিরচেনা । তিনি যাদের পড়িয়েছেন তারাই যেন আজ বেঞ্চে বসে আছে।
তিনি তার সময়কার স্মৃতিচারণ করে বলেন সে সময়ে তিনি একজন চেয়ারম্যানের বাড়ি জায়গীর থাকতেন। তিনি চিকনাই নদীতে গোসল দিতেন। হেটে স্কুলে আসতেন। গোসল দেয়ার সময়ই প্রচুর মাছ ধরতে পারতেন। এখন নাকি বিলগুলো থাকলেও পর্যাপ্ত পানি বা মাছ নেই। তিনি জানান, তার কথা শুনে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ও উপজেলা চেয়ারম্যান অন্য কাজ কর্ম রেখে চলে এসেছেন। এ বিষয়গুলো একজন শিক্ষকের জন্য অনেক গৌরবের। জীবন সায়াহ্নে এসে তার মনে এসব স্মৃতি গেঁথে থাকবে।
বিদ্যালয়র বর্তমান প্রধান শিক্ষক সাইদুল হক জানান, আমাদের এ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক আজো মনে রেখেছেন সোনালী অতীত। এটা অত্যন্ত গৌরবের একটি বিষয়। আমরাও তাকে অভিবাদন জানাই।
হাবিববুর রহামনেরই প্রাক্তন ছাত্র ও উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ মাস্টার জানান, আমার জীবনে নিশ্চয়ই কোন ভাল কাজ আছে। যার জন্য বাল্য শিক্ষকের সাথে এখানে এভাবে দেখো হয়ে গেল। তিনি জানান, তিনি তার প্রিয়শিক্ষকদের ভুলে যাননি। তাদের দোয়ায় এগিয়ে যেতে চান।
পাবনার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক অধ্যক্ষ আলহাজ¦ মাহাতাব উদ্দিন বিশ্বাস বলেন, একজন শিক্ষক সমাজের জন্য যে কী অমূল্য সম্পদ তা ফুটে উঠল এ বিদ্যালয় দেখে। যিনি কার্যত শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন স্কুলটি। সেটি আজ প্রতিদিন উন্নতি করছে। এখানে পাঠদানে শিক্ষা নিয়ে কেউ আজ সরকারের উচ্চপদে আসীন, কেউ হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কেউ বড় লেখক, কেউবা নানা কর্মে সমাজে দেশে বড় নাম করেছেন। এ গৌরব সবার আগে একজন শিক্ষকের।