শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে
- প্রকাশিত সময় ১১:২২:১৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২২
- / 112
আজ ১৪ই ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে যে মুক্তিযুদ্ধ ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল তা ব্যাপকতা লাভ করে ৯ মাস পর্যন্ত। ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালি বুদ্ধিজীবী নিধন ইতিহাসের নৃশংশতম ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড। জাতি যখন প্রত্যাশিত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে সেইসময় পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে। এ ছিল পরিকল্পিত এক ফ্যাসিস্ট নিধন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।
মূলত পাকিস্তানি দুর্বত্তরা বাঙালি নিধন শুরু করেছিল ১৯৬৯ সাল থেকেই। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের প্রক্টর, রসায়ন বিভাগের মেধাবী শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে পাকিস্তানি মিলিটারি ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। এমনকি একাত্তর সালের ১৬ ই ডিসেম্বরের পরেও বুদ্ধিজীবী নিধন অব্যাহত থাকে। যেমন: ড. মনসুর আলীকে হত্যা করা হয় ২১ ডিসেম্বর আর ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২ অমর চলচ্চিত্রকার, কথাশিল্পী, সাংবাদিক জহির রায়হানকে আলবদর বাহিনীরা বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে। তারা মরণ কামড় দিয়ে ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদগণ অর্থাৎ যারা ছিল জাতির দিশারী, পথপ্রদর্শক তাদেরকে সু পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের এই নীল নকশা প্রণয়ন করে পূর্ব পাকিস্তানি গর্ভনরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। ১২ ডিসেম্বর সেনা দপ্তরে আলবদর ও আলশামস্ধসঢ়; বাহিনীর সাথে এক বৈঠক শেষে রাও ফরমান আলী তাদের হাতে তুলে দেন বুদ্ধিজীবীদের এ তালিকা। পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র সহায়তা নিয়ে তাদেরই ছত্রছায়ায় আধা সামরিক বাহিনী আল বদরের ক্যাডাররা ও আলশামস্— রাজাকারেরা এ বর্বোরচিত হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করে।
বিজয়ের সোনালী সুতায় লেখা ১৬ই ডিসেম্বর।
“স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়,” বাঙালী কবির মর্মবেদনার অবসান ঘটিয়ে হাজার বছরের ইতিহাসে ৭১ সালের
১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাঙালী জাতীর আনুষ্ঠানিক সুমহান অভ্যুদয় ঘটে।
এই দিনে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর দখল থেকে অপরাজেয় বাঙালী তাদের স্বদেশ ভূমি বাংলাদেশকে মুক্ত ও স্বাধীন করে। কিন্তু এই ঐতিহাসিক দিবসের গৌরব অর্জনের পথ ছিল অত্যন্ত কঠিন। পাক হানাদার বাহিনী স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র বাঙালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গণহত্যায়। বহু আকাংখিত স্বাধীনতার জন্য এবং মহান বিজয় অর্জনের জন্য ত্রিশ লাখ বাঙালীকে জীবন দিতে হয়েছে। আড়াই লক্ষ মা—বোনকে সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে। অনেক রক্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় যখন বাঙালীদের হাতের নাগালে, যখন সুনিশ্চিত বিজয় অর্জন করতে চলেছে বাঙালীরা, তখনই কুখ্যাত হানাদার বাহিনী পরাজয়ের পূর্বে নতুন করে নীল নকশা আঁটে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার। তারা ভেবেছিল স্বাধীনতা পেলেও যাতে বাঙালি জাতি কান্ডারীহীন তরীর মত অবস্থা হয়। দেশ পরিচালনায় যাতে কেউ না থাকে, তাইতো জাতিকে মেধাহীন করতে, জাতিকে দিক নির্দেশকহীন করতে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। বাঙালী জাতি যাতে দেশ গড়ার কাজে শক্তিশালী হতে না পারে সে জন্য তারা পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে রাও ফরমান আলীর পরিকল্পনায়। যে বাবা মা তার সর্বস্ব ত্যাগের বিনিময়ে নিঃস্ব হয়ে সন্তানকে একটা পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে সেই মা বাবা হলো পুত্রহীন। স্ত্রী হলো স্বামীহারা, সন্তান হলো পিতৃহারা।
আজ সেই দিন যেদিন এদেশের বুদ্ধিজীবী হিসেবে খ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, বৈজ্ঞানিক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, শিল্পী, রাজনীতিকদের বাড়ি থেকে টেনে হিঁচরে চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়ে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়। ১৪ই ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলার খ্যাতিমান চিকিৎসক পাবনার সন্তান ডাঃ ফজলে রাব্বি, সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ, , লেখক মুনীর চৌধূরী, লেখক আনোয়ার পাশা, জে সি দেব, সৈয়দ নাজমুল হক, সৈয়দ আব্দুল মান্নান, ডঃ আবুল কালাম আজাদ, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, বগুড়ার অধ্যাপক মহসীন আলী, মোফাজ্জাল হায়দার চৌধূরী, জ্যোর্তিময় গুহ ঠাকুরতা, শহীদুল্লাহ কায়সার, সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন, গোলাম মোস্তফা, ডঃ আলীম, ডঃ মুক্তাদীর, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সহ নাম না জানা অসংখ্য শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। যারা সেদিন ঘাতকের হাতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলন বস্তুত: তারাই তাদের লেখনী ও কীর্তির মধ্য দিয়ে নয় মাসের অমানিশার অন্ধকারে আমাদের স্বাধীনতার দীপশিখা জ্বালিয়ে রেখেছিলেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীদের ওপর শোষন ও নির্যাতন চালাবার পথ বেছে নেয়। ব্রিটিশ উপনিবেশিকতার নাগপাশ মুক্ত হলেও বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যে জোটে পশ্চিম পাকিস্তাানী শাসনের শৃংখল।
পাকিস্তানী শাসনে বাঙালীদের দাবিয়ে রাখতে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর প্রথমে আঘাত হানার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীরা ছিল তাদের জিঘাংসার টার্গেট। বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীকার সংগ্রামে রাজনৈতিক নেতৃত্ব মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন তাদের প্রেরণার উৎস।
তারা তাদের কবিতা, গান, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস ও নাটকের মাধ্যমে এ জিাতকে পথ দেখাতে সাহায্য করেছেন। জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। যে কারণে পাকিস্তানী হানাদারদের মূল টার্গেটেই ছিল বুদ্ধিজীবীরা, মুক্তিযুদ্ধে তাদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে ওঠার মুহূর্তে তারা আলবদর নামে নয়া নাৎসীদের দ্বারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
১৯৭১ সালের ১লা ডিসেম্বর থেকে ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাক হানাদার বাহিনী এদেশের অসংখ্য বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে এদেশের মানুষের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ইতিহাসকে মুছে ফেলার তথা জাতির মেরুদন্ড ভেঙে দেয়ার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। কিন্তু ওই নরপশুরা জানত না মৃত্যুর পরেও অমর হয়ে থাকবেন স্বাধীনতার জন্য জীবন দেয়া বুদ্ধিজীবীরা।
১৪ই ডিসেম্বর বাঙালী জিাতর সেই হারানো শ্রেষ্ঠ সন্তাানদের গভীর শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করার দিন। এদিন শুধু বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ দিবসই নয়,নয় শুধু শোক দিবস— এ দিন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ সমুন্নত রাখার দূর্বার শপথ নেবার দিন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিষ্ট