ঈশ্বরদীর পদ্মানদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে হাজার হেক্টর চাষের জমি বিলীন, দিশেহারা কৃষক
- প্রকাশিত সময় ১০:৫৮:১০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২২
- / 124
পদ্মানদীর ঈশ্বরদী সাঁড়া ইউনিয়নের ইসলামপাড়া ও সাঁড়া মৌজা। পদ্মানদীর বুকে হাজার হেক্টর চাষের জমি। পদ্মার এই চরই ওই দুই মৌজার কয়েকশত কৃষকের চাষাবাদের একমাত্র জমি। আর এই জমিতেই ধান, গম, ভুট্টা, বাদাম, গোল আলু, মিষ্টি আলু, মিষ্টি কুমড়া, কলা, বেগুন, মুলা, গাজর, ধনিয়া পাতা, আখসহ বিভিন্ন ধরণের ফসলের চাষ করা হয়।
এ অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষের জীবিকার নির্বাহের প্রধান ক্ষেত্রই হলো চরের এ জমি। পদ্মানদীর ফসলের সেই চরঘেঁষে অবৈধভাবে কয়েকশত ড্রেজার নৌকা দিন রাতে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে প্রতি মহুর্তে সেই আবাদী চরের জমি ভেঙ্গে বিলিন হচ্ছে পদ্মানদীতে। তবে প্রশাসনের দাবী পদ্মানদীর নাটোরের লালপুরের সীমানা থেকে বৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
যদি ঈশ্বরদীর সীমানার মধ্যে বালু উত্তোলন করা হয় তা প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়েই বালু খাদকরা উত্তোলন করছে। এভাবে বালু উত্তোলন করায় রাষ্ট্র হারাচ্ছে অর্ধশত কোটি টাকা রাজস্ব।
বালুখাদকের রয়েছে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় পদ্মানদীতে হারানো শেষ সম্বল জমির মালিক প্রান্তিক কৃষকরা প্রতিবাদ কিংবা কোনরুপ মুখ খুললেই নেমে আসে নির্যাতন।
প্রতিবাদকারী কৃষক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের শাসিয়ে ও ভয় দেখিয়ে আসা হয়। এভাবেই পদ্মানদীর ঈশ্বরদী সীমানা থেকে বালু উত্তোলন করছে ঈশ্বরদীর সাঁড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের লোকজন। সাংবাদিকদের নিকট এসব অভিযোগ করেন সাঁড়া ইউনিয়নের সাঁড়া ও ইসলামপাড়া মৌজার মোল্লাপাড়া, খাঁ পাড়ার অর্ধ শতাধিক কৃষক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা।
গত ১৫ দিন ধরে পদ্মার নাটোরের লালপুর, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা ও পাবনা ঈশ্বরদীর সাঁড়া এলাকা ঘুরে বালু উত্তোলনকারী শ্রমিক, নৌকার মাঝি, বালু ক্রেতা, বালুর নৌকা থেকে অবৈধভাবে টোল আদায়কারী ও ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সরেজমিনে পদ্মানদীতে গিয়ে বালু ড্রেজিং নৌকার শ্রমিক, বালু ব্যবসায়ী ও পদ্মানদীতে বালু নৌকা থেকে চাঁদা আদায়কারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি বছরের মাঝামাঝিতে পদ্মানদী থেকে ড্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলনের সরকারীভাবে অনুমোদন নিয়ে আসেন নাটোরের লালপুর বাগাতিপাড়ার এক এমপি। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কুষ্টিয়া ভেড়ামারা এলাকার অপ্রতিরোধ্য প্রধান বালু খাদক সরকার দলের এক প্রভাবশালী নেতার ভাগ্নে। আর ঈশ্বরদী থেকে যুক্ত হয়েছেন সাঁড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। নকশা অনুসারে লালপুর, ভেড়ামারা ও ঈশ্বরদীর ত্রিমুখী অবস্থান থেকে বালু উত্তোলনের অনুমোদন রয়েছে। কয়েকশত ড্রেজারযুক্ত নৌকা বালু উত্তোলন কাজ করছে। কিন্তু সাঁড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের লোকজন বালু উত্তোলনের সেই অনুমোদনের কাগজ নিয়ে অবৈধভাবে ঈশ্বরদীর সীমানার আবাদী চর ঘেঁষে বালু উত্তোলন করছেন।
সুত্রগুলো মতে, সাঁড়ার চেয়ারম্যানের নির্দেশে ও তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন অর্ধশতাধিক নৌকা লালপুর সীমানা থেকে বালু উত্তোলন করছে। সেই নৌকাগুলো ধীরে ধীরে ঈশ্বরদীর সাঁড়া ইউনিয়নের ইসলামপাড়া ও সাঁড়া মৌজায় চলে আসে। আর সেখান থেকে বালু উত্তোলন করে। কারণ সাঁড়ার ইসলামপাড়া ও সাঁড়া মৌজার ওই চর ঘেঁষে মোটা বালু রয়েছে। এখানকার প্রতি ঘনফুট বালু বিক্রয় হয় ১৪-২৫ টাকা পর্যন্ত। তবে দিনের বেলায় পদ্মাতীরে ওই চরের আশপাশে গণমাধ্যম কর্মীদের ক্যামেরাসহ আনাগোনা দেখা গেলেই নৌকাগুলো ধিরে ধিরে লালপুরের দিকে চলে যায়। এই সুকৌশলের মাধ্যমেই ওই চর ঘেঁষে দিন রাতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
সাঁড়া ইউনিয়নের ইসলামপাড়া মৌজার খাঁপাড়ার বাসিন্দা ও চরের জমিতে আবাদকারী কৃষকরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করে জানান, সাঁড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এমদাদুল হক রানা সরদারের লোকজন প্রায় অর্ধশতাধিক ড্রেজার নৌকা লাগিয়ে তাঁদের চরের ফসলী জমি ঘেঁষে বালু উত্তোলন করছেন। এতে নিচ থেকে বালু সরে যাওয়ায় চরে জমি ভেঙ্গে ফসলসহ নদীতে বিলিন হচ্ছে। কৃষকরা প্রতিবাদ করলেই সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী প্রতিবাদকারীদের উপর হামলা চালায় মারপিট করে। ভয়ভীতিও প্রদান করে। সন্ত্রাসীদের হামলা ও হয়রানির ভয়ে কৃষকরা তাদের শেষ সম্বল চরের আবাদী জমি হারিয়েও নির্বিকার রয়েছেন।
লক্ষ্মীকুন্ডা নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ গোলাম মোস্তফা মুঠোফোনে বলেন, পদ্মানদীর ঈশ্বরদী সাঁড়া ইউনিয়নের ইসলামপাড়া ও সাঁড়া মৌজার চর ঘেঁষে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সঙ্গে নৌ-পুলিশের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। খোঁজ নিয়ে বিষয়টি দেখা হবে। তবে লালপুরের একটি পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলনের অনুমতি নিয়ে চেয়ারম্যান এমদাদুল হক রানা সরদারের লোকজন বালু উত্তোলন করার কথা জানি।
ঈশ্বরদী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) অরবিন্দ সরকার বলেন, পদ্মানদীর ঈশ্বরদী সীমানার মধ্যে থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টি জানা নেই। লালপুরের সীমানায় বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তবে ঈশ্বরদী সীমানায় বালু উত্তোলন করা হচ্ছে কিনা তা খোঁজ নেয়া হবে।
পদ্মানদী থেকে বালু উত্তোলনকারী সাঁড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এমদাদুল হক রানা সরদার বলেন, অভিযোগগুলো মিথ্যা। আমরা ৬ কোটি টাকা দিয়ে অনুমোদন নিয়ে পদ্মানদীর লালপুর সীমানা থেকে বালুু উত্তোলন করছি। পদ্মানদীর ঈশ্বরদী পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে না।
পাবনা ঈশ্বরদীর সাঁড়া ইউনিয়নের সাঁড়া ও ইসলামপাড়া মৌজার পদ্মানদীর মোল্লার চর থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে পাবনা জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন মুঠোফোনে বলেন, “পাবনার ঈশ্বরদীতে পদ্মানদী থেকে বালু উত্তোলনের জন্য কাউকে ইজারদারি দেওয়া হয়নি। বালু উত্তোলনের বিষয়টি খোঁজ নিচ্ছি”।