লক্ষণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকার
ডিমেনশিয়া /স্মৃতিভ্রংশ
- প্রকাশিত সময় ০৭:৩৪:১৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৩
- / 299
অনুমান করা হয় যে বিশ্বব্যাপী ডিমেনশিয়ার ৪০% কেস বিভিন্ন ঝুঁকির কারণগুলির দিকে মনোযোগ দিয়ে এড়ানো যেতে পারে।’ ফটোগ্রাফ: সংগৃহীত
আমার চেম্বারের অভিজ্ঞতা থেকে:-
জনাব রশিদ তালুকদার দীর্ঘ ৩৬ বছর শিক্ষকতার জীবন থেকে অবসরে গেছেন প্রায় ১০ বছর। তার বাড়ির লোকজন বলছে গত তিন বছর ধরে তিনি জিনিস পত্র হারিয়ে ফেলছেন, টাকা পয়সার হিসাব তেমন মনে রাখতে পারছেন না। ইদানীং এই সমস্যা আরো বেশি প্রকট হয়েছে। সকালে কি খেয়েছেন তা দূপুর পেরোতেই বিকেলে ভুলে যান। এ নিয়ে পরিবারের সদস্যরা কখনো হাসাহাসি আবার রাগারাগি ও করে। নিজের এ অবস্থায় তিনি বিমর্ষ হয়ে যান এবং খিটখিটে স্বভাবের হয়ে যাচ্ছেন।
….এই রোগটির নামই “ডিমেনশিয়া” যা সহজ ভাষায় স্মৃতিভ্রংশ বা চিত্তভ্রংশ বলে থাকে।
১। ডিমেনশিয়া কি?
(ক) এটি একটি “নিউরো সাইকিয়াট্রিক” রোগ যেখানে মস্তিষ্কের স্নায়ুক্ষয় বা দীর্ঘদিন স্নায়ুর অকার্যকারিতার জন্য আক্রান্ত ব্যাক্তির স্মৃতি, বুদ্ধি এমনকি ব্যাক্তিত্বও লোপ পায়। এটি একটি দীর্ঘ মেয়াদি ও ক্রমবর্ধমান রোগ।
২। কাদের হয়?
(ক) জরিপে দেখা গেছে ৬৫ বছরের বেশি ৫ শতাংশ ও ৮৫ বছরের বেশি লোকদের ২০ শতাংশ লোকেরা এই রোগে আক্রান্ত হয়। এছাড়াও যেকোনো বয়সে যেকোনো বয়সের লোক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এমনকি বাংলাদেশে ২০১৫ সালে এই রোগের আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ লাখ। যাহা ২০৩০ সালে বেড়ে এর সংখ্যা ৯ লাখ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
৩। এই রোগের কারণ কি?
(ক) কিছু ডিমেনশিয়া আছে যেটা ক্রমবর্ধমান এবং এদের সম্পূর্ণ রুপে ভালো করা যায় না। যেমন: আলঝেইমার’স রোগ, লিউ- বডি, ফ্রন্টোটেম্পোরাল, ভাস্কুলার ডিমেনশিয়া, পারকিনসন সিনড্রোম ইত্যাদি। এদের মধ্যে কিছু লোকের বংশগতভাবে ও হয়ে থাকে।
৪। সেকেন্ডারি ডিমেনশিয়া:
এই রোগের সম্পূর্ণভাবে নিরাময় সম্ভব।
(ক)পুষ্টিহীনতা:- শরীরে আয়রন, ফলিক এসিড, ভিটামিন বি১, বি৬, বি১২ এর স্বল্পতা, এলকোহল, নিকোটিন।
(খ) ইনফেকশন: এনসেফালাইটিস, সিফিলিস ও এইডস।
(গ) মেটাবলিক: ডায়বেটিস, থাইরয়েডের রোগ ও অন্যান্য হরমোন জনিত রোগ।
(ঘ)ডিপ্রেশন ও সিজোফ্রেনিয়া।
(ঙ) মস্তিষ্কের টিউমার ও আঘাতজনিত রোগ।
৫। রোগের লক্ষণ:
(ক) সাম্প্রতিক ঘটনা, নাম,চেহারা ভুলে যাওয়া।
(খ) অল্পসময়ের মধ্যে একই প্রশ্ন পুনরাবৃত্তি করা।
(গ) জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলা বা ভুল স্থানে রাখা।
(ঘ) অনুভূতি ও ব্যাক্তিত্বের পরিবর্তন।
(ঙ) মনোযোগ নষ্ট হওয়া।
(চ) হারিয়ে যাওয়া।
(ছ) সরল সিদ্ধান্ত গ্রহণে কঠিন হয়ে যাওয়া
(জ) অনেক সময় নিকট আত্মীয়দের চিনতে না পারা।
৬। রোগ নির্নয় ও চিকিৎসা:-
(ক) বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয়। তবে দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এর ক্রমবর্ধমান গতিকে রোধ করা যায়। এজন্য পারিবারিক ও সামাজিক জনসচেতনতা হওয়া দরকার।
৭। রোগ প্রতিরোধ:-
(ক) ডায়বেটিস, কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা।
(খ) অ্যালকোহল,ধুমপান পরিত্যাগ করা।
(গ)সবসময় ঘরে বসে না থেকে নিজের পছন্দের কাজ করা।সামাজিক কার্যক্রমে নিজেকে জড়িত রাখা।
(ঘ)বয়স অনুযায়ী সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা।
(ঙ) হরমোন জনিত রোগ ও পুষ্টিহীনতা নিয়ন্ত্রণ করা।
(চ) পরিবারের সদস্যদের এই রোগ সম্পর্কে অবিহিত করতে হবে এবং রোগীর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে হবে।
(ছ)পারিবারিক ও সামাজিক জনসচেতনত।
৮। ডিমেনশিয়া থেকে রক্ষা পেতে:-
(ক) প্রথমেই নিজেকে ও পরিবারের সদস্যদৈরকে সচেতন হতে হবে।
ডিমেনশিয়া একটি নিউরো ডিজেনারেটিভ রোগ। সাধারণত ৬০-৬৫ বছরে হলেও আজকাল পঞ্চাশের কোঠা থেকে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে এই ভুলে যাওয়া অসুখে। তবে রোগটি প্রকাশ পাওয়ার কয়েক বছর আগে থেকেই কিন্তু ধীরে ধীরে লক্ষণ জানান দেয়। আর ঠিক তখনই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কারণ সঠিক সময়ে ডিমেনশিয়া শনাক্ত করে চিকিৎসা করলে রোগীর আয়ু কিছু বছর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়।
৯। লক্ষণ:-
(ক) ডিমেনসিয়ার অনেক রকম লক্ষণ। মনে রাখতে হবে ডিমেনশিয়ার কারণে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায় বেশী। কিন্তু ভুলে যাওয়াই ডিমেনশিয়ার একমাত্র লক্ষণ নয়। ডিমেনশিয়ার সাধারণ উপসর্গ হল সাম্প্রতিক কালের কিংবা একদিনের মধ্যে হওয়া কোনও ঘটনা, খুব পরিচিত কারোর নাম ভুলে যাওয়া, স্বল্পমেয়াদি স্মৃতিহ্রাস, বার বার একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা, সময় সম্পর্কে জ্ঞান হারিয়ে যাওয়া, টাকাপয়সার হিসাব করতে ভুল হওয়া, ঘনঘন মেজাজের পরিবর্তন, কোনও বিষয়ে সহজে সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, একই কাজে বেশিক্ষণ মনোযোগ রাখতে না পারা, নতুন জায়গায় গেলে হারিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
১০। কখন ঝুঁকি বেশি?
(ক) শরীরে কোনও ক্রনিক রোগ থাকলে অল্প বয়সে ডিমেনশিয়ার লক্ষণ শুরু হয়ে যেতে পারে বা ডিমেনশিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে হার্টের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল, থাইরয়েডসহ কোনও কোমর্বিটি থাকলে আগে সেগুলির নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। আবার বংশগতভাবেও ডিমেনশিয়া হতে পারে।
১১। কী কী কারণে আক্রান্ত হতে পারেন?
(ক) অ্যালঝাইমার হলে ডিমেনশিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু মনে রাখতে হবে অ্যালঝাইমারই একমাত্র কারণ নয়। বেশি মদ্যপান, মস্তিষ্কে কোনও টিউমার কিংবা ব্রেনে রক্ত জমাট বাঁধলে, ভিটামিন বি-১২-এর অভাব, থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, রক্তে গ্লুকোজ কম থাকলে, কোনও নিউরো ডিসঅর্ডার থাকলে তা থেকে ডিমেনশয়া দেখা দিতে পারে।
১২। ওষুধ ছাড়াও প্রতিরোধ:-
(ক)ডিমেনশিয়া চিকিৎসার আগে রোগীর কোনও ক্রনিক রোগ থাকলে আগে সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
অ্যালকোহল সেবন ও ধূমপান কম করতে হবে।
(খ) ব্যালান্সড ডায়েট মেনে চলতে হবে। বেশি করে ফল, সবজি ডায়েটে রাখতে হবে।
(গ) ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
নিয়মিত এক্সারসাইজ করতে হবে। পেশাগত কাজ ছাড়াও মস্তিষ্ক যাতে সক্রিয় থাকে এমন কোনও কাজে নিজেকে যুক্ত রাখতে হবে।
(ঘ) ডিমেনশিয়া রোগীর পরিবারের সদস্যদের সাহায্য গুরুত্বপূর্ণ। অনেকসময় রোগী নিজের মধ্যে লক্ষণ বুঝতে পারেন না কিংবা রোগটি লুকিয়ে রাখতে চান। তাই আপনি যদি বুঝতে পারেন প্রিয়জন ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন তাহলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের মানসিকভাবে রোগীর পাশে থাকা খুব জরুরি।
লেখক: ডাঃ পীযুষ মজুমদার
এম.বি.বি.এস, বি.সি.এস. এম.ডি. নিউরোমেডিসিন।