রূপপুরে রাশিয়ানদের মুখে বাংলাভাষা, মিশে গেছে বাংলা-রুশ ভাষা, রাশিয়ানদের অনেকেই করছেন দোভাষীর কাজ
- প্রকাশিত সময় ১২:৫৫:০৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
- / 303
প্রিভিয়াত, দ্রাসভিচা, দ্রবরে উতরে, দ্রবরে উতরে দ্বীন, দ্রবরে উতরে ভীসের, দ্রবরে নচি, কাক ভাচ ডেলা, স্পাচিবা, বালশোয়ে স্পাচিবা, ইসভিনিত, পাজালাসতা এগুলো রাশিয়ান শব্দ। শব্দগুলোর বাংলা ভাষায় মানে হলো, শুভ সকাল, শুভ মধ্যহ্ন, শুভ সন্ধ্যা, শুভ রাত্রি, কেমন আছেন, ধন্যবাদ, অসংখ্য ধন্যবাদ, ক্ষমা করবেন বা দুঃখিত, আবার আসবেন। এভাবেই নতুনহাট মোড় রাশিয়ানদের বসবাসকৃত গ্রিনসিটি এলাকায় সকাল সন্ধ্যা বা রাত্রিতে বাঙ্গালি ও রাশিয়ানদের ভাবের আদান প্রদান হচ্ছে। গ্রিনসিটি এলাকার দোকান, খাবার হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন ধরণের পণ্য বিক্রয়ের দোকানগুলোর রাশিয়ান ভাষায় রাখা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে টাঙ্গানো হয়েছে রাশিয়ান ভাষায় বিলবোর্ড। হঠাৎ করে কোন ব্যক্তি নতুনহাট এলাকায় বেড়াতে আসলে প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইনবোর্ড, রাশিয়ানদের চলাফেরা, সকল ধরণের ব্যবসায়ীদের মুখে রাশিয়ান ভাষা শুনে অবশ্যয় ধারণা হবে এটা রাশিয়ার একটি শহর। কারণ নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে (আরএনপিপি) কর্মরত রাশিয়ানদের ঘিরে নতুনহাট এলাকার বাজারগুলোতে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রাশিয়ান ভাষা শোনা যায়। রাশিয়ানদের চলাফেরা করেন। তাদের সঙ্গে বাঙ্গালীরাও মাতৃভাষার মতো রাশিয়ান ভাষা বলছেন। তবে বাঙ্গালীদের রাশিয়ান ভাষা শেখার জন্য কোন কোন প্রাতিষ্ঠানিক ট্রেনিং সেন্টার নেই। তবে রাশিয়া ফেরত বাঙ্গালীরা যারা আরএনপিপিতে রাশিয়ানদের দো-ভাষী হিসেবে কাজ করছেন, তাদের কেউ কেউ স্থানীয়ভাবে রাশিয়ান ভাষা শেখানোর জন্য কোচিং সেন্টার চালু করেছেন। সেখান থেকে কিছু বাঙ্গালী রাশিয়ান ভাষা শিখেছেন। কিছুজন গুগুল ট্রানসিলেট থেকে রাশিয়ান ভাষা শিখেছেন। আর অধিকাংশ বাঙ্গালীয় রাশিয়ানদের সঙ্গে প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে ভাষা শিখেছেন। তেমনি রাশিয়ানরাও বাঙ্গালীদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বাংলা ভাষা শিখেছেন।
গতকাল (শনিবার) বিকেলে নতুনহাট রাশিয়ান পল্লী গ্রিনসিটির সামনের কাপড় ব্যবসায়ী মোঃ সাজ্জাদ হোসেন এক রাশিয়ানকে দেখে বললেন, দ্রাসভিচা ( কেমন আছেন)। চোতো ভাম সজনো (কি লাগবে)। রাশিয়ান বললেন, পোতেবয়েতসা পলনিনি সতানি বল্ সগো (বড় মাপের ফুল প্যান্ট ), পসিম টাকা (দাম কত), তি স্তো পিদিসাদ টাকা। পাজালাসতা ( আবার আসবেন)। স্পাচিবা (ধন্যবাদ)।
ফল বিক্রেতা রায়হান আলী বলেন, কয়েক বছর ধরে নতুনহাট গ্রিনসিটি এলাকায় ফল বিক্রয় করছি। রাশিয়ানরা দোকানে এসে আপেল দেখিয়ে বলতে ইয়াব্লুগা, কমলা দেখিয়ে সাদ্রারিন, মাল্টা দেখিয়ে এমেলতিন, আঙ্গুর দেখিয়ে বলতো ভিনাগ্রাফ। এভাবে শুনতে শুনতে রাশিয়ান ভাষা শিখে গেছি।
সবজি বিক্রেতা মোঃ লিটন বলেন, রাশিয়ান ভাষায় লেটুস পাতাকে লেতুস ভ সালাতা, শসাকে আকবি, পুদিনাকে মেথা, পেয়াজকে লুগ এবং পেয়াজ পাতাকে জিলনা লুগ, ধনিয়া পাতাকে কিংজা, তরমুজকে আরমুজ, বেগুনকে পাকল দা, আলুকে কার তস্কা বলেন।
নিজস্ব মাতৃভাষা রুশকি ভাষা ছাড়া অন্যকোন ভাষা শেখায় তেমন একটা অনাগ্রহী রাশিয়ান নাগরিক। তবে বাংলাদেশে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে (আরএনপিপি) কাজে এসে অন্যভাষা শেখার সেই অনাগ্রহটার অনেকটায় কেটেছে রাশিয়ানদের। এখন বাংলাভাষা কথা বলেন। ভাষা ভাষার সঙ্গে বাঙ্গালী সংস্কৃতিও পালন করছেন। আবার রাশিয়ানদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রয়োজনে উঠাবসা করতে ও রাশিয়ানদের অনুকরণ করে রুশকি ভাষা শিখেছে বাঙ্গালী শ্রমিক, দোকানী, চালকসহ সর্বশ্রেণীর মানুষ। প্রকল্পে কর্মরত প্রায় ৩২ হাজার বাঙ্গালী শ্রমিক কর্মকর্তা, রুশ, বেলারুশ, ইউক্রেন, জর্জিয়া, তাজিকিস্তান, কাজাখিস্তান ও ভারতসহ প্রায় ৩ হাজার ৫শ জন বিদেশী নাগরিক ও ২৫০ থেকে ৩০০ জন বাঙ্গালী দোভাষী কর্মরত রয়েছেন। এখন প্রকল্পে রাশিয়ানসহ বিদেশীদের মুখে বাংলা ভাষা। আর বাঙ্গালীদের মুখে রুশ ভাষা। বিগত ৮ বছর ধরে নতুন করে মিলে মিশে একাট্টা হয়ে গেছে রুশ-বাংলা। আর তাই আরএনপিপিতে বাঙ্গালীদের পরিবর্তে বাংলা ভাষা শেখা রাশিয়ানদের অনেকেই করছেন দো-ভাষীর কাজ।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প (আরএনপিপি) নির্মাণ কাজের মূলঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান রাশিয়ান মালিকানাধীন এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট (এএসই), প্রকল্পে কর্মরত বিভিন্ন সাব-ঠিকাদারি প্রতিষ্টান সুত্র জানায়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে পদ্মানদীর তীরস্থ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। বাঙালী শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করা ও বাংলাদেশী বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য রাশিয়াতে লেখাপড়া করা বাঙ্গালীদের দো-ভাষী হিসেবে রাশিয়ানদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকল্পের নির্মাণ কাজের পাশাপাশি বাঙ্গালীদের দোকানগুলোতে কেনাকাটা করার জন্য বাঙ্গালী দোভাষীদের সঙ্গে নিতেন রাশিয়ানরা। কিন্তু কয়েক বছরের ব্যবধানে রাশিয়ানদের প্রায় প্রত্যেকেই বাংলা ভাষার অনেক কিছুই শিখেগেছে। সঙ্গে বাঙ্গালী সংস্কৃতি, খাবার, আচার ব্যবহার। এমনকি প্রকল্পে কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠায় তাদের বাড়ির বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও রাশিয়ানদের অবাধ চলাফেরা রয়েছে।
সুত্রগুলো মতে, আরএনপিপির নির্মাণকাজে নিয়োজিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে প্রায় ২৫০-৩০০ জন রুশ ভাষা জানা বাঙ্গালী দোভাষী রয়েছে। তবে এখন রাশিয়ানরা নিজেরাই বাংলা ভাষা শিখে গেছে। অনুরুপ শ্রমিকরাও রুশ ভাষা শিখেছে। পাশাপাশি রূপপুর, নতুনহাট, ঈশ্বরদী,পাবনা, কুষ্টিয়া, নাটোরসহ আশেপাশের এলাকার দোকানী, পরিবহন শ্রমিক, হোটেল ব্যবসায়ী, ভিক্ষুকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ কমবেশি রুশভাষা শিখে গেছে। এই কারণে অনেক ক্ষেত্রেই এখন রাশিয়ানরা আর বাঙ্গালী দোভাষী তেমন একটা ব্যবহার করছে না।
আরএনপিপির মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাশিয়ানদের মালিকানাধীন এটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট (এএসই) কোম্পানির কয়েকজন কনসালটেন্ট ও রাশিয়ান কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রাশিয়ানরা নিজস্ব রুশ ভাষা ছাড়া অন্যকোন পরদেশী ভাষায় কথা বলতে চাননা। এই কারণে তারা অন্যভাষা শিখতে সর্বদা অনাগ্রহী। তবে বাংলাদেশে দেশে এসে তাদের প্রত্যেকেই বাংলা ভাষা শিখেছেন। এরমুল কারণ হলো বাংলাদেশ- রাশিয়ার বন্ধুপ্রতিম দেশ।
তারা আরও জানান, ২০১৩ সালে রূপপুর প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে পর্যায়ক্রমে ১০ হাজারের মতো গ্রেট রাশিয়া থেকে শ্রমিক কর্মচারী এসেছেন। কয়েক বছর ধরে কাজ করেছেন। তাদের প্রত্যেকেই বাংলা ভাষা শিখে গেছেন। রুপপুর প্রকল্পের কারণে বাংলা ভাষা রাশিয়ায় মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। এতে পুরো রাশিয়া হয়তো এক সময় বাংলা ভাষা ও বর্ণের সঙ্গে পরিচিত হতেন পারেন। এমন ধারণায় ব্যক্ত করেছেন ওই কর্মকর্তাগণ।