ফেনীর কনডেম সেলের কথা বলেই” আদালতে কাঁদলেন বাবুল আক্তার
- প্রকাশিত সময় ১০:০৯:২৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ ২০২৩
- / 141
কারাগারে ‘কষ্টের’ কথা তুলে ধরে আদালতের সামনে কেঁদেছেন স্ত্রী খুনের মামলায় বিচারের মুখোমুখি হওয়া সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার। এসময় তিনি আদালতকে জানান, তাকে ফেনী কারাগারে কনডেম সেলে রাখা হয়েছে।
সোমবার (১৩ মার্চ) বিকেলে দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে চাঞ্চল্যকর মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি হয়। অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য আসামি বাবুল আক্তারকে ফেনী কারাগার থেকে সোমবার সকালে চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হয়। শুনানিতে নিয়ম অনুযায়ী আদালত তিনি দোষী নাকি নির্দোষ জানতে চান।
বাবুল আক্তার নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। এ মামলার কোনোপর্যায়ে আমার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।’
শুনানি শেষে আদেশ দেওয়ার আগে বাবুল আক্তার আবারও আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘ফেনী কারাগারে আমাকে রাখা হয়েছে কনডেম সেলে। আমি তো কনডেম সেলে রাখার মতো আসামি না।’ এ সময় আদালত মন্তব্য করে জবাব দেন, ‘কনডেম সেলে আপনাকে তো একা রাখা হয়েছে আপনার নিরাপত্তার জন্য। এটি তো নিশ্চয় টেম্পরারি।’
এরপর বাবুল আক্তার বলেন, ‘আমি অসুস্থ। আবেদন করেও আমি চিকিৎসা পাচ্ছি না। ডাক্তার দেখানোর সুযোগ দিচ্ছে না। তিন বছর আগে দেওয়া ডাক্তারের চিকিৎসাপত্রের ওষুধ আমাকে খেতে হচ্ছে।’
আদালত মন্তব্য করেন, ‘আপনি অসুস্থ হলে প্রতিকার পাওয়ার অধিকার আপনার আছে। আপনি বাংলাদেশের নাগরিক। চিকিৎসার অভাবে আপনি ভুগবেন কেন ? আর থাকা খাওয়ার কোনো বেসিক সমস্যা হলে সেগুলো দেখভাল করার জন্য জেল কর্তৃপক্ষ আছে। এরপর আদালতেরও সুযোগ আছে।’
এ পর্যায়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবুল আক্তার বলেন, ‘আমি চাই আমাকে বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করা হোক।’
আদালত মন্তব্য করেন, ‘সেই সুযোগও জেল কর্তৃপক্ষের আছে। জেল সুপার তো আছেই। আদালতের কাছেও আপনি রিপোর্ট করতে পারেন। যদি জেল কর্তৃপক্ষ রেসপন্স না করে, দ্যান ইউ রিপোর্ট আস।’
চট্টগ্রাম কারাগারেও নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম কারাগারে আমার অনেক শত্রু আছে। চট্টগ্রামে অনেক সন্ত্রাসীকে আমি গ্রেফতার করেছি। তাদের বেশিরভাগই চট্টগ্রাম কারাগারে আছে। আমি আমার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।’
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মহানগর পিপি আবদুর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনি (বাবুল আক্তার) বোঝাতে চেয়েছেন তিনি দীর্ঘদিন এখানে ছিলেন। এখানে তার মিত্র-শত্রু দু’টিই আছে। এখানে থাকলে উনার ক্ষতি হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেছেন। উনি হুমকির মধ্যে আছেন সেটিও তিনি বলেছেন। এটি আদালতের এখতিয়ার।’
এদিকে অভিযোগ গঠন থেকে বাবুল আক্তারকে অব্যাহতির আবেদনও করেছিলেন তার আইনজীবীরা। আদালত সেটা খারিজ করে দিয়েছেন।
বাবুল আক্তারের আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ সারাবংলাকে বলেন, ‘অব্যাহতির আবেদন আদালত খারিজ করে দিয়েছেন। আমরা আদালতকে বলেছিলাম, এই মামলায় বেশকিছু দুর্বলতা আছে। এই মামলার মূল যে ব্যক্তি মুসা, যার ব্যাপারে বার বার বলা হচ্ছে সেই মুসার কোনো হদিস নেই। যার সঙ্গে প্রণয়ের বিষয় নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলে মামলায় বলা হয়েছে, সে মহিলারও কোনো হদিস নেই। তার কোনো ১৬১ ধারার জবানবন্দি নেই, সাক্ষ্য নেই। তাহলে কিসের ভিত্তিতে বাবুল আক্তারকে এই মামলায় সম্পৃক্ত করা হলো।’
এদিকে আবেদনের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) প্রসিকিউশন শাখার অতিরিক্ত উপ কমিশনারের কক্ষে বাবুল আক্তারকে বিকেলে সাড়ে ৪টা থেকে এক ঘণ্টা আইনজীবীদের সঙ্গে বৈঠকের সুযোগ দেন আদালত।
অভিযোগপত্রে প্রধান আসামি করা হয়েছে মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারকে। অভিযোগপত্রে আরও যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন- মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু এবং শাহজাহান মিয়া। এতে মুসা ও কালুকে পলাতক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা নাটকীয়তার পর ওই বছরের আগস্টে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তখনই মিতু হত্যায় বাবুল আক্তার জড়িত এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।
হত্যাকাণ্ডের পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন প্রথম এই খুনে বাবুলের জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করেন। নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাত ঘুরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলার তদন্তভার পড়ে পিবিআইয়ের ওপর। এরপর আস্তে আস্তে জট খুলতে থাকে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টিকারী চাঞ্চল্যকর এই মামলার।
২০২১ সালের ১১ মে বাবুল আক্তারকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। পরদিন বাবুল আক্তারের মামলায় আদালতে ৫৭৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, যাতে উল্লেখ করা হয়- তদন্তে ঘটনার সঙ্গে বাদী বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
একইদিন (১২ মে) দুপুরে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারসহ আটজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পিবিআই হেফাজতে থাকা বাবুল আক্তারকে মোশাররফের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
এরপর আদালতে দেওয়া গ্রেফতার ভোলাইয়া, বাবুলের ঘনিষ্ঠ সাইফুল হক, গাজী আল মামুন, মোকলেসুর রহমান ইরাদ এবং আসামি মুসার স্ত্রী পান্না আক্তারের জবানবন্দিতে বাবুলের সম্পৃক্ততার তথ্য আরও জোরালো হয়।
তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এসব জবানবন্দির একপর্যায়ে নিজের মামলায় পিবিআইয়ের দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি আবেদন দাখিল করেন বাবুল আক্তার। ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর শুনানি শেষে আদালত বাবুল আক্তারের নারাজি আবেদন প্রত্যাখান করেন।