ঈশ্বরদী ইপিজেডে নাকানো কোম্পানির তিন কর্মকর্তার সেচ্ছাচারিতায় আতংকে ২ হাজার শ্রমিক
- প্রকাশিত সময় ১২:২৮:৩৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ মে ২০২৩
- / 504
পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডে জাপানিদের মালিকানাধীন নাকানো ইন্টারন্যাশনাল কোঃ লিঃ এর বাঙালী শীর্ষ তিন কর্মকর্তার সেচ্ছাচারিতার কারনে আতংকে রয়েছে কারখানার প্রায় দুই হাজার শ্রমিক ও কর্মচারী।
কখন যে কার চাকরি চলে যায় এই আশংকায় দিন কাটাচ্ছেন কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারিগণ।
নাকানোর এই তিন শীর্ষ কর্মকর্তা ইতোমধ্যে ১৮ জন শ্রমিক ও কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করেছেন। পর্যায়ক্রমে চাকরীচ্যুতির জন্য করেছেন তালিকা। এনিয়ে কারখানার শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
এই তিন কর্মকর্তারা হলেন, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপক (এডমিন ম্যানেজার) মোঃ মেহেদী হাসান, উৎপাদন ব্যবস্থাপন (পিএম) মোঃ আব্দুল মতিন ও সহকারী উৎপাদন ব্যবস্থাপক (এপিএম) মোঃ ফরহাদ বাবু।
সূত্রমতে, এই তিন বাঙালী কর্মকর্তার ভয়াবহ অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা ধরার কারণেই গত ২৭ মার্চ নানা ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে কারখানার শ্রমিকদের দিয়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কোম্পানির নির্বাহী কর্মকর্তা ও দো-ভাষী সুইটি আক্তারের অপসারণের আন্দোলন করান।
ফলে চাকরিচ্যুত হন, কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক জাপানি নাগরিক কাজী হারা ও নির্বাহী কর্মকর্তা দো-ভাষী সুইটি আক্তার।
শ্রমিক আন্দলোনের কারন উদঘাটনের জন্য নাকানো কোম্পানি ও বেপজা থেকে তদন্ত কমিটি করা হয়। কিন্তু নাকানোর করা তদন্ত কমিটিরই ২ সদস্যকে কোম্পানি থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। কারন তারা তদন্তে এই শীর্ষ তিন কর্মকর্তার যোগসাজশের প্রমাণ পেয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শ্রমিক কর্মচারী জানান, এসকল অনৈতিক কাজ তারা সফলভাবে করছেন জাপানি ভাষা জানার কারনে। আর আমরা বাঙালি শ্রমিক কর্মচারীরা জাপানি মালিক পক্ষের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে ভাষা না জানার কারনে। এই তিনজন সুকৌশলে জাপানি ভাষা পারে এবং তাদের দুর্নীতিতে সহায়তায় অস্বীকারকারীদের চাকরিচ্যুত করছেন। যেন তারা কোম্পানিতে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে, তাদের লুটপাটে কেউ বাধা দিতে না পারে।
নাকানো কোম্পানিকে টিকিয়ে রাখতে ওই তিন বাঙ্গালী তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহনের দাবীতে কোম্পানির শ্রমিক কর্মচারীদের পক্ষ থেকে ঈশ্বরদী ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) বরাবর অভিযোগ করা হয়েছে।
নাকানোর করা তদন্ত কমিটি ওই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শ্রমিক কর্মচারীদের নানা রকম মিথ্যা প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলন করিয়ে কোম্পানিটির সুনাম ক্ষুন্নসহ অর্থনৈতিকভাবে লোকসান করার সত্যতা পেয়েছে বলে তদন্ত কমিটি সুত্রে জানা গেছে।
তারপরও চাকরীতে বহাল তবিয়তে রয়েছেন ওই তিন কর্মকর্তা। কারণ তারা জাপানি ভাষা জানেন। একারনে ওই তিন কর্মকর্তার রোষানলে পড়া শ্রমিক কর্মচারীদের জাপানে থাকা মালিকের নিকট অসত্য তথ্য উপস্থাপন করে খুব সহজেই চাকরীচ্যুত করিয়েছেন।
বেপজায় লিখিত অভিযোগ, শ্রমিক কর্মচারী ও নাকানোর তদন্ত কমিটির সদস্যদের সুত্রে জানা যায়, কোম্পানির ওই তিন বাঙ্গালী কর্মকর্তা পরস্পর যোগসাজছে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি করছেন। তাদের এসব অনিয়ম দুর্নীতির প্রকাশ হওয়ার আশংকা দেখা দিলে তারা বিভিন্ন প্রলোভন ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে অন্যান্য শ্রমিক কর্মচারীদের উস্কে দিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করান। ফলে চাকরীচ্যুত করা হয় কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক ও নির্বাহী কর্মকর্তাকে। কোন কারণে আন্দোলনকারী শ্রমিক কর্মচারীরা ওই তিন কর্মকর্তার বিষয়ে মুখ খুললে তারা জাপানি মালিককে নানা রকম অসত্য তথ্য দিয়ে তাদেরও চাকরীচ্যুত করান।
সুত্রগুলো মতে, নাকানো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিটি একটি লাভজনক কোম্পানি। কিন্তু ওই তিন কর্মকর্তার যোগসাজশে বার্ষিক ক্রয় কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেন। এই কারণে কোম্পানিটির জাপানি মালিকসহ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিঃ কাজী হারা এসব অনিয়ম ও দুর্নীতিগুলো ধরার জন্য দায়িত্ব দেন নির্বাহী কর্মকর্তা সুইটি আক্তারকে। খোঁজ খবর নিয়ে সুইটি আক্তার ওই কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অনিয়ম ধরতে পারেন। এরপরই ওই তিন কর্মকর্তা সুপরিকল্পিতভাবে সুইট আক্তারসহ কাজী হারাকে চাকরীচ্যুত করতে আন্দোলন করান। এতে কোম্পানিতে চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
কোম্পানির একাধিক শ্রমিক জানান, আমরা এডমিন ম্যানেজার মেহেদী হাসান, পিএম আব্দুল মতিন, এপিএম ফরহাদ বাবু স্যারসহ কয়েকজন স্যারের কথা মতো আন্দোলন করেছি। আমাদের মধ্যে থেকে যারা তদন্ত কমিটির নিকট সত্যতা স্বীকার করেছেন তাদের চাকরীচ্যুত করা হয়েছে। আমরা এখন চাকরীচ্যুত হওয়ার আশংকার মধ্যে রয়েছি। এসব নিয়ে কোম্পানিতে শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে চরম অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে।
তারা আরও জানান, কোম্পানির প্রধান নির্বাহী পরিচালক জাপানি নাগরিক কাজী হারা জাপানে ফিরে গেছেন। এই সুযোগে জাপানি ভাষা জানা এডমিন ম্যানেজার মেহেদী হাসান, পিএম আব্দুল মতিন জাপানে থাকা কোম্পানির মালিকের নিকট শ্রমিক কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে একের পর এক চাকরিচ্যুত করছেন।
নাকানো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিঃ এর স্টোরকিপার সজল আহমেদ জানান, ওই তিন কর্মকর্তা কারখানার বিভিন্ন মালামাল ক্রয় ও সাব কন্ট্রাক্ট, যন্ত্রপাতি মেরামতে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করেন। এইসব দুর্নীতি ধরেন নির্বাহী কর্মকর্তা সুইটি আক্তার। এরপরই তার বিরুদ্ধে ওই তিন কর্মকর্তা শ্রমিক কর্মচারীকে মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে উস্কে দিয়ে আন্দোলন করিয়েছেন। শ্রমিক কর্মচারীরা তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তদন্ত কমিটির নিকট মুখ খোলায় আমাদের চাকরীচ্যুত করেছেন।
সুইং অপারেটর সোহানা ইয়াসমিন, শাপলা খাতুন, রানী, মহির উদ্দিন, রমজান আলী, ফিরোজ আহমেদ জানান, কোম্পানির এডমিন ম্যানেজার মেহেদী হাসান, পিএম আব্দুল মতিন ও এপিএম ফরহাদ বাবু নিজেরা দুর্নীতি করে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাদের স্বার্থে আমাদের মিথ্যা তথ্যে দিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করিয়েছেন। আমরা পরবর্তিতে বিষয়টি বুঝতে পেরে তদন্ত কমিটির নিকট সত্যটা প্রকাশ করায় আমাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
আয়রনম্যান তৌসিফ, ইমরান, ফিরোজ, ওয়াশ হেলপার আল মামুন, কাটিংম্যান মাসুদ রানা জানান, কোম্পানির তিন কর্মকর্তা আমাদের দিয়ে আন্দোলন করিয়েছেন। আমরা তদন্ত কমিটির নিকট বলে দেওয়ায় আমাদের চাকরিচ্যুত করেছেন। আমরা জানতে পেরেছি পর্যায়ক্রমে আরো চাকরীচ্যুত করার জন্য তালিকা তৈরী করেছেন।
নাকানোর নির্বাহী কর্মকর্তা ও দো-ভাষী সুইটি আক্তার জানান, নাকানো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। প্রতি বছর কোম্পানির লাভ করার কথা। কিন্তু প্রত্যেক বছরই কোম্পানিটির আয়-ব্যয় সমান হচ্ছে। এই কারণে আমাকে কোম্পানির পক্ষ থেকে বিষয়টি অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অনুসন্ধান করতে গিয়ে এডমিন ম্যানেজার মেহেদী হাসান, পিএম আব্দুল মতিন, এপিএম ফরহাদ বাবুসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে এক বছরে একটি ফ্লোরেই কয়েক কোটি টাকার দুর্নীতিসহ অনিয়ম ধরে ফেলি। বিষয়টি তখন আমি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী পরিচালক কাজী হারাকে অবগত করি। এরপরই ওই তিন কর্মকর্তা মিথ্যা তথ্য দিয়ে শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে আন্দোলন করান। তার প্রমান তদন্ত কমিটি পেয়েছেন। বর্তমানে কোম্পানিতে জাপানি কোন পুরাতন কর্মকর্তা না থাকার সুযোগে তারা শ্রমিক কর্মচারীদের একের পর এক চাকরীচ্যুত করিয়ে সত্যটি ঢাকার চেষ্টা করছেন।
শ্রমিক কর্মচারীদের করা আন্দোলনের বিষয়ে নাকানো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির করা তদন্ত কমিটির রকিব আহমেদ ও মোঃ সুমন জানান, তদন্তে শ্রমিকদের মিথ্যা প্রলোভনে উস্কে দিয়ে আন্দোলন করিয়েছেন এডমিন ম্যানেজার মেহেদী হাসান, পিএম আব্দুল মতিন, এপিএম ফরহাদ বাবুসহ কয়েকজন কর্মকর্তা। এর প্রমান পাওয়া গেছে। বর্তমানে কোম্পানিতে তারা ছাড়া জাপানি ভাষাজানা গুরুত্বপূর্ন কোন কর্মকর্তা না থাকায় তদন্ত প্রতিবেদনটি জাপানি মালিকদের নিকট প্রদান করা সম্ভব হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদনে ওই তিন কর্মকর্তাসহ আরও কয়েকজন জড়িত প্রমানসহ প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করায় আমাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনটি মালিকের হাতে দিতে হলে তাদের মাধ্যম দিয়েই দিতে হবে। তাই চাকরীচ্যুত হওয়ার ভয়ে অন্যরা প্রতিবেদনটি মালিকের নিকট জমা দিতে পারছে না।
নাকানো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিঃ এডমিন ম্যানেজরা ও দো-ভাষী মোঃ মেহেদী হাসান জানান, চাকরীচ্যুত হওয়ার পর এখন আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছে। আমরা শ্রমিকদের চাকরীচ্যুত করার ক্ষেত্রে কিছুই জানিনা। শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে আন্দোলন করানোর তথ্যটি সত্য নয়। শ্রমিকরা নিজেরাই আন্দোলন করেছে। আর কোম্পানির আর্থিক কোন দুর্নীতির সঙ্গে তিনি জড়িত নন। বেপজা থেকে তদন্ত করেও আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগের সত্যতা পায়নি বলেও দাবী করেন এই কর্মকর্তা।
কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার (পিএম) মোঃ আব্দুল মতিন জানান, শ্রমিক আন্দোলন, চাকরীচ্যুত করা ও আর্থিক কোন দুর্নীতির সঙ্গে তিনি জড়িত নন। এগুলো তার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করা হচ্ছে।
ঈশ্বরদী ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) মোঃ আনিসুর রহমান জানান, নাকানো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিটিতে শ্রমিক আন্দোলন ও চাকরীচ্যুত করার ঘটনায় বেপজা থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। কোম্পানিটি জাপানি মালিকানাধীন। তাই যেকোন বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়াটা সময়ের ব্যাপার।