যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান খান
- প্রকাশিত সময় ০১:৩৮:০৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৩
- / 45
দুর্নীতি মামলায় ইমরান খানের কারাদণ্ড, তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে যখন সরগরম পাকিস্তানের রাজনীতির মাঠ; ঠিক তখনই মিলল চাঞ্চল্যকর এক তথ্য। দেশটির সরকারের একটি গোপন নথি ফাঁস করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্টারসেপ্ট জানিয়েছে, ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ইসলামাবাদকে চাপ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
ইন্টারসেপ্টের হাতে আসা পাকিস্তান সরকারের ওই নথি অনুসারে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়ায় ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করার জন্য মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ২০২২ সালের ৭ মার্চ এক বৈঠকে পাকিস্তান সরকারকে ‘উৎসাহিত’ করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের দুই কর্মকর্তার মধ্যে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। নথিটি ইন্টারসেপ্টকে সরবরাহ করেছে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর একটি সূত্র। তবে ইমরান খান বা তার দল পিটিআই’র সঙ্গে সূত্রটির কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানানো হয়েছে।
ফাঁস হওয়া নথি অনুসারে, মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের এক মাস পরই পাকিস্তানের সংসদে একটি অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয়, যার মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হয় ইমরান খানকে। ধারণা করা হয়, এই ভোটের পেছনে ছিল পাকিস্তানের ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর সমর্থন।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও বর্তমান শাহবাজ সরকারের সঙ্গে নানা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন ইমরান ও তার দল পিটিআই’র সমর্থকরা। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর পদ হারানোর পর প্রকাশ্যে ইমরান খান একাধিকবার দাবি করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের চাপেই তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হয়েছিল। যদিও শাহবাজ ও বাইডেন সরকার বারবার সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
গত বছরের ৭ মার্চের ওই বৈঠক সংক্রান্ত নথি পাকিস্তানে পাঠানো হলেও তা কখনো প্রকাশ করা হয়নি। অভ্যন্তরীণভাবে এটি ‘সাইফার’ নামে পরিচিত, যার মাধ্যমে ইমরান খানকে উৎখাতে মার্কিন সরকারের দ্বিমুখী চরিত্র বেরিয়ে এসেছে। কারণ, ইমরানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিলে পাকিস্তানের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর সেটি না করা হলে, ইসলামাবাদকে দেয়া হয় বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার হুমকি।
‘গোপন’ লেবেলযুক্ত নথিটিতে, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত মাজিদ খানসহ স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠকের একটি বিবরণ রয়েছে।
কূটনৈতিক ওই বৈঠকটি হয় ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের দুই সপ্তাহ পর, ঠিক সেই সময় যখন ইমরান খান মস্কো সফরে যাচ্ছিলেন। মূলত ইমরান খানের এই সফরই ওয়াশিংটনকে ক্ষুব্ধ করেছিল। বৈঠকের কয়েকদিন আগে, ২ মার্চ সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির এক শুনানিতে ডোনাল্ড লু’র কাছে জানতে চাওয়া হয় ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানের নিরপেক্ষতার বিষয়ে।
এসময় লু বলেন, ‘ইমরান খান সম্প্রতি মস্কো সফর করেছেন। আমরা তার এই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে কীভাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত হতে পারি, তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করছি।’
এছাড়া ওই বৈঠকের আগের দিন এক সমাবেশে ভাষণ দেয়ার সময় যুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন দেয়ার ইউরোপীয় আহ্বানের সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানান ইমরান খান। তিনি বলেন, ‘আমরা কি গোলাম? আপনারা আমাদের সম্পর্কে কী ভাবেন? যে আমরা আপনাদের দাস এবং আপনারা আমাদের কাছে যা চাইবেন আমরা তাই করব? আমরা রাশিয়ার বন্ধু এবং যুক্তরাষ্ট্রেরও বন্ধু। আমরা চীন ও ইউরোপের বন্ধু। কিন্তু আমরা কোনো জোটের অংশ নই।’
নথি অনুসারে, বৈঠকে ডোনাল্ড লু পাকিস্তানের অবস্থান নিয়ে ওয়াশিংটনের অসন্তোষ সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ যথেষ্ট উদ্বিগ্ন যে পাকিস্তান কেন এমন আক্রমণাত্মকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান নিচ্ছে (ইউক্রেনের বিষয়ে)। এমন অবস্থান যদি সম্ভবও হয়, তা-ও এটা আমাদের কাছে নিরপেক্ষ অবস্থান বলে মনে হয় না।’
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে এ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ আলোচনা করার কথা জানিয়ে লু আরও বলেন, ‘বিষয়টি বেশ স্পষ্ট যে, এটি প্রধানমন্ত্রীর নীতি।’
নথিতে বলা হয়েছে, এরপর লু পাকিস্তানে অনাস্থা ভোটের ইস্যুটি উত্থাপন করেন। বলেন,
আমি মনে করি, যদি প্রধানমন্ত্রীর (ইমরান খান) বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট সফল হয় তাহলে ওয়াশিংটন সবকিছু ভুলে যাবে। তা না হলে সামনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে (পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে)। কারণ, রাশিয়া সফরের বিষয়টিকে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ডোনাল্ড লু হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, পরিস্থিতির সমাধান না হলে পাকিস্তান তার পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘আমি জানিনা এটি ইউরোপ কীভাবে দেখবে, তবে আমার ধারণা তাদের প্রতিক্রিয়া একই রকম হবে। ইমরান খান ক্ষমতায় থাকলে পাকিস্তান ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্নতার সম্মুখীন হতে পারে।’
পাকিস্তান সরকারের ওই নথিতে লু’র বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, ‘এই কথিত মন্তব্যে প্রমাণ হয় না যে, পাকিস্তানের নেতা কে হবেন সে বিষয়ে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।’ এছাড়া, ব্যক্তিগত কূটনৈতিক আলোচনার বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি মিলার।
ওই বৈঠকের পরের দিন, ৮ মার্চ, পাকিস্তানের সংসদে ইমরান খানের বিরোধীরা অনাস্থা ভোটের পদক্ষেপ নেয়।
এ বিষয়ে মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের অনাবাসিক স্কলার এবং পাকিস্তানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আরিফ রফিক বলেছেন, ‘বৈঠকটি হওয়ার সময় ইমরান খানের ভাগ্য নির্ধারিত হয়নি, তবে এটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল। বাইডেন প্রশাসন জনগণের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছিল যে, তারা যাকে পাকিস্তানের প্রকৃত শাসক হিসেবে দেখছিল, তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিলে পরিস্থিতি আরও ভালো হবে।
নথিটির সব তথ্য যাচাই করার চেষ্টা করেছে ইন্টারসেপ্ট। তবে পাকিস্তান সরকারের সূত্র থেকে স্বাধীনভাবে এটি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি। এছাড়া ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাস থেকেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
তবে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র মিলার বলেছেন,
আমরা ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের দিন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মস্কো সফর নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছি এবং সেই বিরোধিতাকে প্রকাশ্যে ও ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছি।
‘পাকিস্তানের নেতৃত্ববিষয়ক অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ মিথ্যা। এই অভিযোগ সবসময়ই মিথ্যা ছিল,’ যোগ করেন তিনি।