মোটরসাইকেলে ঘষা লাগায় হত্যা করা হয় সঞ্জিত রায়কে
- প্রকাশিত সময় ০২:১৪:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৪
- / 100
ঈদ উপলক্ষে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার শিবনগর ইউনিয়নের দুধিপুর এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানি প্রবাহের ক্যানালের ওপর নির্মিত ব্রিজের পার্শ্বে বসেছিল কিছু অস্থায়ী দোকানপাট। সেখানে মোটরসাইকেল নিয়ে যান সঞ্জিত রায় (৩৫)। সেই ব্রিজের ওপর ছিল আরো তিনটি মোটরসাইকেল। এর মধ্যে একটি মোটরসাইকেলের সাথে ঘষা লাগে সঞ্জিত রায়ের মোটরসাইকেলটি। এতেই ঘটে বিপত্তি।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অজ্ঞাত ৬ থেকে ৭ জন যুবক সঞ্জিত রায়কে বেধরক মারপিট করে শুরু করে। এতে এক প্রত্যক্ষদর্শী দেখে বাঁধা প্রদান করলেও থামানো যায়নি ওই যুবকদের। মারপিটের এক পর্যায়ে তারা সঞ্জিত রায়কে ব্রিজ থেকে ৩০ ফুট গভীরে ক্যানালে ফেলে দেয়। এতেই তার মৃত্যু হয়েছে।
ওই যুবকদেরকে আটকের অনেক চেষ্টা করা হলেও তাদেরকে আটক করা সম্ভব হয়নি। তবে তারা একটি মোটরসাইকেল ফেলে পালিয়েছে। মোটরসাইকেলটি থানায় জমা দেয়া হয়েছে। এমনটাই বলছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলায় সাক্ষী কোকিল রায়।
ঈদের দিন গত বৃহস্পতিবার ১১ এপ্রিল ফুলবাড়ী উপজেলার শিবনগর ইউনিয়নের দুধিপুর গ্রামে ক্যানালের পানি থেকে সঞ্জিত চন্দ্র রায় (৩৫) নামের এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে থানা পুুলিশ। সঞ্জিত রায় দুধিপুর গ্রামের খগেশ্বর চন্দ্র রায়ের ছেলে।
প্রথমে তার মৃত্যু নিয়ে ধুম্রজাল তৈরি হলেও মৃত্যুর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষী পাওয়ায় পরদিন শুক্রবার (১২ এপ্রিল) নিহত সঞ্জিত চন্দ্র রায়ের স্ত্রী প্রিয়াংকা রানী পিংকি বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ৬-৭ জন যুবকের বিরুদ্ধে ফুলবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার ১১ এপ্রিল উপজেলার শিবনগর ইউনিয়নের দুধিপুর এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানি প্রবাহের ক্যানালের ওপর নির্মিত ব্রিজ এলাকায় ঈদ উপলক্ষে বসে কিছু অস্থায়ী দোকানপাট। ওইদিন বিকেল ৫টার দিকে সঞ্জিত রায় তার স্ত্রী প্রিয়াংকা রানী পিংকি ও শ্যালিকা বৃষ্টি রায়কে সাথে নিয়ে সেখানে কেনাকাটা করতে যান। সেখান থেকে সাড়ে ৬ টার দিকে স্ত্রী ও শ্যালিকাকে বাড়ীতে রেখে আসেন।
পরে পুনরায় সঞ্জিত রায় মোটরসাইকেল যোগে সেখানে যান। এসময় সেই ব্রিজের ওপর ছিল আরো তিনটি মোটরসাইকেল। এর মধ্যে একটি মোটরসাইকেলের সাথে ঘষা লাগে সঞ্জিত রায়ের মোটরসাইকেলটি। এতে ব্রিজের ওপর অবস্থানকারী অজ্ঞাত পরিচয়ের ৬-৭ জন যুবক সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সঞ্জিত চন্দ্র রায়কে বেধড়ক মারপিট শুরু করে। পরে তাকে ক্যানালের প্রায় ৩০ ফুট গভীরে ফেলে দেয়। এতে ক্যানালের মধ্যেই সঞ্জিত চন্দ্র রায়ের মৃত্যু হয়।
মামলার বাদী প্রিয়াংকা রানী পিংকি বলেন, “ঈদের দোকান থেকে কেনাকাটা করে বাড়ীতে এসে রাতের রান্না করার এক পর্যায়ে গ্রামের কয়েকজন আত্মীয় জানান, আমার স্বামী সঞ্জিত রায়ের মরদেহ তাপবিদ্যুতের ক্যানালের পানিতে ভাসছে। বিষয়টি জানার পরপরই বাড়ীর সকলে সেখান গিয়ে পানি থেকে উদ্ধার করে ফুলবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।”
“পরে জানতে পারি, আমাদেরকে বাড়ীতে পৌঁছে দিয়ে পুনরায় ঈদ বাজারে যায় আমার স্বামী। এসময় ক্যানালের ফুটব্রিজের ওপর অবস্থানকারী অজ্ঞাত পরিচয়ের ৬-৭ জন যুবকের তিনটি মোটরসাইকেলের একটির সাথে নাকি আমার স্বামীর মোটরসাইকেলের সামান্য ধাক্কা (ঘসা) লাগে। তখন ওই যুবকরা আমার স্বামীকে বেধড়ক পিটিয়ে প্রায় ৩০ ফুট গভীরের ক্যানালে ফেলে দেয়। ওই রাতেই ঘটনাস্থল থেকে আমার স্বামীর মোটরসাইকেলসহ ঘাতকদের একটি এ্যাপাচি আরটিআর ১৬০ সিসি এর মোটরসাইকেল থানায় জমা দিয়েছেন গ্রামবাসী।”
পিংকি আরও বলেন, স্বামীকে হত্যার পর আমার ৬ বছরের একমাত্র ছেলে শিশির রায় ধ্বনি সবসময় বাবাকে খুঁঁজছে। বাবাকে না পেয়ে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সেসব সময় তার বাবার সঙ্গেই খেত।
এই এতিম ছেলেকে কিভাবে মানুষ করবেন এমন চিন্তাই তিনি বিচলিত হয়ে পড়েছেন পিংকি। এদিকে শুক্রবার ১২ এপ্রিল সঞ্জিত রায়ের মরদেহ ময়না তদন্তের জন্য দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠায় থানা পুলিশ।
এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একই গ্রামের মৃত গোষ্ট বিহারীর ছেলে কোকিল বিহারী (৫০), বাঘাচড়া গ্রামের খিতিশ চন্দ্র রায়ের ছেলে তপন চন্দ্র রায় (৩০) ও পাবর্তীপুর উপজেলার শেরপুর (মহেন্দ্রপাড়া) গ্রামের অমূল্য রায়ের ছেলে সুমনসহ আরো বেশ কয়েকজন।
মামলার সাক্ষী কোকিল বিহারী (৫০) বলেন, ঈদ বাজারে থাকার সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে দেখতে পাই ক্যানালের ফুটব্রিজের ওপর কয়েকজন অজ্ঞাত পরিচয়ের যুবক সঞ্জিত চন্দ্র রায়কে মারপিট করছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদেরকে বাঁধা প্রদান করি। কিন্তু ওই যুবকরা আমার কথায় কর্ণপাত না করে সঞ্জিত চন্দ্র রায়কে মারপিট করতেই থাকে। মারপিটের একপর্যায়ে তারা সঞ্জিত রায়কে ব্রিজ থেকে ক্যানালের নিচে ফেলে দেয়। এরপরই যুবকরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। এসময় তাদের তিনটি মোটরসাইকেলের মধ্যেই চাবি লাগানো থাকায় আমি চাবি তিনটি খুলে নিয়ে তাদেরকে বাধা দেওয়ার পাশাপাশি চিৎকার শুরু করি। তখন যুবকরা আমার কাছ থেকে জোরপূর্বক দুইটি মোটরসাইকেলের চাবি ছিনিয়ে নিলে আমার হাতে থাকা অন্য একটি মোটরসাইকেলে চাবি পার্শ্বে থাকা ঝোপে ফেলে দেই। ফলে একটি মোটরসাইকেল ফেলে দিয়েই ঘাতকরা পালিয়ে যায়। পরে মোটরসাইকেলটি থানায় জমা দেওয়া হয়েছে।
নিহত সঞ্জিত চন্দ্র রায়ের বাবা খগেশ্বর রায় (৫৫) বলেন, আমার ছেলে খুবই শান্ত প্রকৃতির ছিল। কারো সাথে কোনোদিন ঝগড়া করেনি। কিন্তু আমার ছেলেকে ওই ঘাতকরা নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে। এখন আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো। আমার একমাত্র ছেলে সঞ্জিত রায়-ই ছিল পরিবারের অবলম্বন। তাকেও কেড়ে নিলো ঘাতকরা। আমি ঘাতকদের ফাঁসি চাই। তাদের ফাঁসি হলে আমার ছেলের আত্মা শান্তি পাবে।
নিহত সঞ্জিত চন্দ্র রায়ের মা বীনা রানী (৪৮) বলেন, আমাদের বৃদ্ধ বয়সের অবলম্বন ছিল একমাত্র বুকের ধন সঞ্জিত। তাকেও আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিল ঘাতকরা। এদের যেন বিচার হয়। আপনারা সবাই মিলে ঘাতকদের বিচারের ব্যবস্থা করেন।
ফুলবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজার রহমান বলেন, মামলা পেয়েছি। মামলায় উল্লেখিত আসামীরা অজ্ঞাত। তাই তাদের ফেলে যাওয়া মোটরসাইকেলের সূত্র ধরে ঘাতকদের সনাক্তের চেষ্টা অনেকটাই সফল হয়েছে। শিঘ্রই ঘাতকদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার ১১ এপ্রিল সন্ধ্যায় ফুলবাড়ী উপজেলার শিবনগর ইউনিয়নের দুধিপুর এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানি প্রবাহের ক্যানাল থেকে সঞ্জিত চন্দ্র রায়ের (৩৫) মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।