যুবলীগ নেতা আরজু বিশ্বাস একযুগে হয়েছেন শতকোটি টাকার মালিক
- প্রকাশিত সময় ০৮:৩৪:৫১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪
- / 22
আব্দুল্লাহ আল বাকি ওরফে আরজু বিশ্বাস (৫২)। ছিলেন ঈশ্বরদী উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি। আরজু বিশ্বাসের চাচা এনামুল হক এনাম বিশ্বাস পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি। তার সঙ্গে খুবই সখ্যতা রয়েছে স্থানীয় এমপি প্রয়াত শামসুর রহমান শরীফ ডিলু পরিবারের। চাচার তদবিরে পাবনা সুগার মিলের (বর্তমানে উৎপাদন বন্ধ ঘোষিত) ওজন মাপক (কাটা বাবু) পদে চাকরি পান আরজু বিশ্বাস।
বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১/১১ পরবর্তী আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১২ সালে আরজু বিশ্বাস নিজের ও চাচার দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে অবৈধভাবে পাকশী ইউনিয়নের ফটু মার্কেট এলাকায় পদ্মানদী থেকে বালু উত্তোলন করেন। নদীর পাড়ের মাটি কেটে বিক্রয় করেন ইট ভাটায়। আরজু বিশ্বাস ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন চাচা এনামুল হক বিশ্বাসকে। স্থানীয় এমপি ও তার পরিবারের সঙ্গে এনাম বিশ্বাসের বালু মহালের টাকার লেনদেন। ছিল এ কারণে প্রশাসন ছিল তাদের হাতের মুঠোই। পদ্মানদী থেকে বালু উত্তোলন ও পাড়ের মাটি কেটে বিক্রয় করে এক বছরেই বনে যান কোটিপতি।
২০১৩ সালে আওয়ামীলীগ সরকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু করে। তখন থেকেই আরজু বিশ্বাস মেসার্স অর্ক এন্টারপ্রাইজ নামে প্রজেক্টে জোরপূবর্ক ছোটখাট নির্মাণ কাজ শুরু করেন। কাজে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করলেও স্থানীয় আওয়ামীলীগের দাপটে তার বিরুদ্ধে তেমন কোনই পদক্ষেপ নিতে পারেনি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী রাশিয়ান কোম্পানিগুলো।
এমনকি চাচা এনাম বিশ্বাস পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ায় এককভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রকল্প থেকে স্থানীয় কৃষকদের ফসলের ক্ষতিপূরণের তালিকায় আরজু বিশ্বাস নিজের, ছোট ভাইয়ের, বাড়ির কাজের লোক, আত্মীয় স্বজনের নামে বিশেষ চুক্তিতে কৃষকের ক্ষতি পূরণের তালিকায় তোলেন। কৃষকের ক্ষতি পূরণের ২৮ কোটি টাকার মধ্যে থেকে আরজু বিশ্বাস ও তার চাচা চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস হাতিয়ে নেন প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা।
এবিষয়ে প্রতিবাদ করায় নিজ বাড়ির দরজার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বীরমুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম। এ ঘটনায় পুলিশ আরজু বিশ্বাসকে প্রধান সন্দিগ্ধ আসামী হিসেবে বিদেশী পিস্তলসহ আটক করেছিল। টাকা ও দলীয় ক্ষমতার জোরে কিছু দিনের মধ্যেই জামিনে মুক্ত হয়ে নিজ এলাকাসহ আরএনপিপি প্রকল্পের ভিতরে সব কাজে চরম বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আরজু বিশ্বাস। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে (আরএনপিপি) ইট, বালু, পাথর ও ইকুপম্যান্ট সরবরাহের নামে লুটপাট করেছেন কয়েকশত কোটি টাকা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন প্রতিরোধে দলীয় নেতাকর্মীদের আর্থিকসহ নানা ধরণের সহযোগিতা করেন আরজু বিশ্বাস। এ কারণে ৫ আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান আরজু বিশ্বাস ও তার চাচা এনাম বিশ্বাস। কিন্তু গত মাসে স্থানীয় বিএনপি’র কিছু নেতার সঙ্গে ঢাকায় বসে নগদ টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে আরএনপি প্রকল্পে লুটপাটের ঘটনা অব্যাহত রেখেছেন আরজু বিশ্বাস।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার পাকশী রূপপুর ফটু মার্কেট এলাকায় ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত টিনশেড বাড়িতে থাকতেন আরজু বিশ্বাস। স্থানীয় আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতা আরজুর মামা শ্বশুড়। তার মাধ্যমে স্ত্রীকে রূপপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা পদে চাকরি নিয়ে দেন। এরপর এক তলা ছাদের বাড়ি নির্মাণ করেন আরজু বিশ্বাস।
বীরমুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম হত্যায় অস্ত্রসহ আটক হয়ে জামিনে এসে ঈশ্বরদী শহরের সাউথ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় প্রায় সোয়া কোটি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট ক্রয় করেন। স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ের নামে বেনামে কোটি কোটি টাকা এফডিআর ও ডিপোজিট করেছেন। গড়েছেন স্ত্রী ও কন্যার গহনা। ক্রয় করেছেন বিলাস বহুল প্রাইভেট কার, ১০-১২টি অত্যাধুনিক হাইচ মাইক্রো, ৫/৬ টি ড্রাম ট্রাকসহ অন্যান্য ইকুপম্যান্ট। যা আরএনপিপি’তে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। ঢাকার উত্তরায় প্রায় দুই কোটি টাকা দিয়ে ক্রয় করেছেন ফ্ল্যাট, ঈশ্বরদী শহরের বিভিন্ন এলাকায় কিনে রেখেছেন জমি। ঈশ্বরদী সাউথ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পূর্ব পাশে ক্রয় করেছেন প্রায় আড়াই কোটি টাকা দিয়ে ৪ কাটা জমি। সেখানে ১০ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে নির্মাণ করছেন সাত তলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়ি। যার নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের দিকে।
আরজু বিশ্বাস আওয়ামীলীগ সরকারের শাসনামলের মাত্র ১২ বছরে নানা উপায়ে কয়েশত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কিন্তু এসব সম্পদের বিষয়ে কিছুই জানে না আয়কর বিভাগ ঈশ্বরদী উপকর কমিশনারের কার্যালয়ের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা।
রাজশাহী কর অঞ্চল-১২ সার্কেল ঈশ্বরদীর উপকর কমিশনের কার্যালয় সূত্র মতে, আব্দুল্লাহ আল বাকি ওরফে আরজু বিশ্বাসের মালিকানাধীন মেসার্স অর্ক এন্টার প্রাইজের নামে একটি হিসেব খোলা রয়েছে। কিন্তু সেখানে তার সম্পদের তালিকায় সাত তলা বাড়িসহ জমি, ঢাকা উত্তরার ফ্ল্যাট, ঈশ্বরদীর ফ্ল্যাট, জমি, ব্যাংকের টাকার হিসাব, প্রকল্পে থাকা হাইচ মাইক্রো, ড্রাম ট্রাক ও পাইভেটকার উল্লেখ নেই। সূত্রগুলো মতে, এই কার্যালয়ের পূর্বের দুই/একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের যোগসাজসে সম্পদের প্রকৃত বিবরণ উল্লেখ করা হয়নি। এতে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে কেউ লিখিতভাবে অভিযোগ করলে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও সূত্রটি প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
এদিকে পাকশীতে বিভিন্ন সময় হত্যার শিকার হওয়া পরিবারগুলোর দেওয়া তথ্য মতে, আরজু বিশ্বাস রূপপুর- পাকশীতে আতংকিত এক ব্যক্তি। নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হওয়া যুবদল নেতা শিমুল বিশ্বাস, যুবলীগের পাকশী শাখার সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম লাভলু, বীরমুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম, পাকশী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সদরুল আলম পিন্টু, ছাত্রলীগকর্মী তানভির হাসান মনা হত্যা ও যুবলীগকর্মী সৌরভ হাসান টুনটুনির হাত কাটাসহ বিভিন্ন হত্যা ও অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার তীর বরাবরই রয়েছে আরজু বিশ্বাসের দিকে। সেকারনে যুবদল নেতা শিমুল বিশ্বাস ও আওয়ামীলীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম হত্যার ঘটনায় সন্দিগ্ধ প্রধান আসামী হিসেবে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়ে জেল হাজতও খেটেছেন আরজু বিশ্বাস। তাদের মতে, আরজু বিশ্বাস একজন ঠান্ডা মাথার লোক। তাই তাকে নিয়ে সবাই থাকেন চরম আতংকে। কেউ তার কাজে বাধা দিতে সাহস করেন না।
এসব বিষয়ে জানতে গত দেড় সপ্তাহ ধরে আব্দুল্লাহ আল বাকি ওরফে আরজু বিশ্বাস ও তার চাচা এনামুল হক বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তাদের রূপপুর ফটু মার্কেট এলাকার বাড়ি ও শহরের বাড়িসহ নির্মাণাধীন বাড়ির সাইডে যাওয়া হয়। তাদের পরিবারসহ নিকট আত্মীয়রা জানান, ৫ আগস্টের রাতেই আরজু বিশ্বাস ও তার চাচা এনাম বিশ্বাস মোবাইল ফোন বন্ধ করে এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। তাদের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরগুলোও বন্ধ রয়েছে। একারনে কোনভাবেই তাদের কোনরূপ বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।