রাশিয়ার মতো বাংলাদেশও পরমাণু শিল্পে এগিয়ে চলেছে
- প্রকাশিত সময় ০৯:৩৩:২৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২০
- / 108
জ্যোষ্ঠ সাংবাদিক স্বপন কুমার কুন্ডু রাশিয়া হতে ফিরে লেখেন, পরমাণুকে শিল্প হিসেবে গ্রহন করে রাশিয়ার মতো বাংলাদেশও এখন এগিয়ে চলেছে। তবে বিশ্বব্যাপী রাশিয়া একচ্ছত্রভাবে পরমাণু ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য মাঠে নেমেছে। পরমাণু শক্তির মানবতা বিরোধী ব্যবহার পরিহার করে এই শক্তিকে শিল্প হিসেবেই তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগের বিভিন্ন উপায় উদ্ভাবন করেছে। শিল্প কারখানা স্থাপন ও সংস্থাপনের অন্যতম শর্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। আর পারমাণবিক বিদ্যুতের উন্নয়নে দেশটি এখন সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করছে।
রাশিয়া মনে করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বর্তমানে পরমাণু শক্তির ব্যবহার। পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহার বিষয়ে রাশিয়ান বিশেষজ্ঞদের মতে, পরমাণু প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে চিকিৎসা শাস্ত্র, কৃষি খাত, মহাকাশ ও মেরু অঞ্চল গবেষণা এবং অর্থনীতির এনার্জি ভিত্তি সুদৃঢ় করণে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।
বাংলাদেশও এখন পরমাণু নিয়ে গবেষণা এবং এই শক্তিকে অন্যান্য ক্ষেত্রে সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে।
এব্যাপারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব আনোয়ার হোসেন জানান, আমাদের দেশে চিকিৎসা, কৃষি, খাদ্য সংরক্ষণসহ আরো বেশ কিছু ক্ষেত্রে গবেষণা কার্যক্রমের সাথে সাথে আইসোটোপ ব্যবহারের সম্প্রসারণ ঘটচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের অধীনে পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে নানা দুরারোগ্য ব্যাধি শনাক্তকরণ ও চিকিৎসায় প্রয়োগ করা হচ্ছে পরমাণু শক্তি। বিভিন্ন রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ে আইসোটোপের ব্যবহার রয়েছে।
ঢাকার শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস রয়েছে। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাস এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে দুটি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, বগুড়া, কুমিল্লা ও কক্সবাজারে একটি করে সর্বমোট ১৪টি ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস রয়েছে। এর মাধ্যমে বছরে প্রায় ৫ লাখ রোগীকে স্বল্প ব্যয়ে আধুনিক ও উন্নততর চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী ২০২০ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হবে আরও ৮টি নতুন ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস। দূরদূরান্তের রোগীদের দোরগোড়ায় পারমাণবিক চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেবে সরকার।
তিনি আরো বলেন, পারমাণবিক কৌশল কাজে লাগিয়ে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কৃষি খাতে অবদান রেখে চলেছে।
কৃষিতে পারমাণবিক কৌশলের শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন অধিক উৎপাদনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন, ভূমি ও পানির উত্তম ব্যবস্থাপনা, ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নতুন কলাকৌশল উদ্ভাবন এবং ফসলের রোগ ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানের গবেষণার মূল বিষয়। দেশের ঈশ্বরদী, রংপুর, মাগুরা, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা, জামালপুর, খাগড়াছড়ি, সুনামগঞ্জ, শেরপুর, বরিশাল, গোপালগঞ্জ, নোয়াখালী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এটির ১৩টি উপকেন্দ্র রয়েছে বলে তিনি জানান। খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণে ব্যাকটেরিয়াসহ অনেক জীবাণু তেজস্ক্রিয় রশ্মিতে মারা যায়। তাই তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করে খাদ্যদ্রব্য বা ফলমূলকে জীবাণুমুক্ত করে সংরক্ষণ নিয়েও কাজ চলছে।
তবে পারমাণবিক বিদ্যুতের উন্নয়নে রাশিয়া ইতোমধ্যেই অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। বিগত ১০ ও ১১ ডিসেম্বর রাশিয়ায় মিডিয়া ট্যুরে গিয়ে দেখা যায়, রাশিয়ার নভোভরোনেঝ শহরে রয়েছে সবচেয়ে বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প। এখানে একে একে পারমাণবিক বিদ্যুতের সাতটি ইউনিট চালু করা হয়। আয়ুস্কাল শেষ হওয়ায় বর্তমানে ৪টি ইউনিট চালু আছে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৫৮ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সালে যাত্রা শুরু হয়। সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নভোভরনেঝ প্রকল্প। এখানে ২১০ মডেলের রিয়্যাক্টর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্পের যাত্রা শুরু। ১৯৫৮ সালে প্রথম যাত্রা শুরু। ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদন শুরু করে। এসময় একে একে ৫টি ইউনিট স্থাপন করা হয়। থার্ড প্লাস জেনারেশনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ৬নং ইউনিট ভিভিইআর-১২০০ ইউনিট চালু হয় ২০১৬ সালে। একই প্রযুক্তির ৭ নম্বর ইউনিট ২০১৯ সালের মে মাসে চালু হয়। প্রথম তিনটির ইউনিটের আয়ু শেষ হওয়ায় এগুলো বন্ধ। ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিট বর্ধিত সময়ে চলছে। ২০৩২ ও ২০৩৬ সালে এ দুটিরও মেয়াদ শেষ হবে। বর্তমানে নভোভরনেসে ৪টি ইউনিট চালু অবস্থায় দেখা গেছে।
৬ ও ৭ নম্বর ইউনিটের ডেপুটি চীফ প্রকৌশলী ইগোর গোসেভ জানান, জাপানের ফুকুসিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা মাথায় রেখেই ভিভিইআর-১২০০ মডেলের আধুনিক প্রযুক্তির এই রিএ্যাক্টর তৈরী হয়েছে। এটি যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে সক্ষম বলে তিনি দাবী করেন।
জানা যায়, বর্তমানে রাশিয়ায় ১০টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৩৬টি ইউনিট চালু রয়েছে এবং এগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন চলছে। আরও ৬টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নাধীন। মোট ৮টি ইউনিট চালু করা হবে। এছাড়া আরও ২টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নক্শা তৈরির কাজ চলছে। এই প্রকল্প দ’ুটিতে ৬টি ইউনিট থাকবে। পাশাপাশি নভোভরনেঝসহ যেসব ইউনিটের আয়ু শেষ হয়েছে, সেগুলো সংস্কার করে আধুনিকীকরণের পরিকল্পনাও রয়েছে। সব মিলিয়ে ১৮টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে মোট ৬৫টি ইউনিট চালু ও চালুর প্রক্রিয়ার আছে।
ট্রেনিং সেন্টারের ইন্সট্রাকটর নিকোলাই এ্যলেক্স জানান,, রাশিয়া এই ভিভিইআর-১২০০ রিয়্যাক্টর উদ্ভাবনের পর বিভিন্ন দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ভারত, চীন, বেলারুশ, ফিনল্যান্ড এবং হাঙ্গেরি, অত্যাধুনিক এবং সর্বোচ্চ নিরাপদ এই ভিভিইআর-১২০০ রিয়্যাক্টর প্রযুুক্তি বেছে নিয়েছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রিয় পারমাণবিক শক্তি কর্পোরেশন (রসাটম) এসব দেশে ভিভিইআর- ১২০০ প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করছে। বিশ্বের ১২টি দেশে রসাটমের বাস্তবায়নাধীন ৩৬টি ভিভিইআর প্রযুক্তির পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে চলমান রয়েছে।
প্রসঙ্গত: রাশিয়ার রেফারেন্স প্লান্ট ভিভিইআর-১২০০ মডেলের রিয়্যাক্টর বাংলাদেশের ঈশ্বরদীর রূপপুরে দুটি ইউনিট স্থাপনের মহাকর্মযজ্ঞ চলছে। রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশের রূপপুরে ২০২৩ সালে প্রথম ইউনিট এবং ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদন শুরু করবে। এই দুটি ইউনিট হতে ১,২০০+১,২০০= ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। এব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর বলেন, এই রিঅ্যাক্টরটি মনুষ্য-সৃষ্ট কোন দুর্ঘটনা এবং প্রাকৃতিকভাবে ঘটতে পারে এমন যে কোন প্রকার বিপর্যয় যেমন- শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, ভুমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি মোকাবেলায় সক্ষম। রূপপুরে নির্মিতব্য রিঅ্যাক্টরটি এসব দুর্ঘটনা মোকাবেলা করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম থাকবে।
পরমাণু প্রযুক্তি বর্তমান বিশ্বে জীবনমান উন্নয়ন, সমৃদ্ধি অর্জন এবং পরিবেশের প্রতি যুক্তিযুক্ত আচরণের ক্ষেত্রে গৃহীত বিভিন্ন কর্মকান্ডের অবিচ্ছদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নেয়া ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সার্বিক সফলতা কামনা করছি।