কোরবানি আমাদের ত্যাগের শিক্ষা দেয় – মুহাম্মদ ফয়সুল আলম
- প্রকাশিত সময় ০৮:৫২:৩৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২০
- / 124
ধর্মপ্রাণ মানুষ সবসময়ই সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের আশায় থাকে। মুসলমানদের আল্লাহর কাছাকাছি পৌঁছানোর একটি উত্তম পথ কোরবানি দেওয়া।
প্রত্যেক মুসলমান ওয়াজিব হিসেবে কোরবানিতে অংশগ্রহণ করে থাকে। কোরবানি মহিমার বিষয়, শুধু পশু জবাই নয়, এর সাথে ত্যাগ এবং পরিচ্ছন্নতার বিষয় জড়িত। মুসলমানগণ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আযহার দিন বা পরবর্তী দুদিন পশু কোরবানি দিয়ে থাকে।
পশু কোরবানির পর সৃষ্ট বর্জ্য পরিষ্কার করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। সুষ্ঠুভাবে কোরবানি না দিলে পরিবেশ দূষণ ঘটে যা ধর্মীয় এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য। যত্রতত্র কোরবানি দেওয়া; চামড়া, রক্ত, ব্যবহৃত চাটাই ইত্যাদি যাবতীয় আবর্জনা যেখানে-সেখানে ফেলে দেওয়ার ফলে খুব দ্রুত জীবাণু সংক্রমণসহ দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। এতে বায়ু, পানি ও মাটি- তিনটি প্রাকৃতিক উপাদানই দূষিত হয় যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে।
সৌদিআরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে একটি নির্দিষ্ট স্থানে কোরবানি দেওয়া হয়। মুসলমানগণ মসজিদ বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত জবাইখানাতে কাজটি সম্পন্ন করে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশে ঢাকা শহরসহ সারাদেশের ঈদুল আযহা পরবর্তী অভিজ্ঞতা বড়োই তিক্ত। অনেকে নিজেদের সুবিধার জন্য ঘরের কাছে, চলাচলের রাস্তায় কোরবানি দিয়ে থাকেন। তাই ঈদ পরবর্তী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বেশি জরুরি হয়ে পড়ে।
পশু জবাই করার পর রক্ত সাথে সাথে ধুয়ে ফেলতে হবে। রক্ত ধোয়া পানি যেন রাস্তা বা বাড়ির আঙ্গিনায় জমে না থাকে সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। প্রবাহমান নর্দমায় বইয়ে দিতে হবে। এ পানি স্থির হয়ে জমে থাকলে তাতে দুর্গন্ধ ছড়াবে, মশা ও জীবাণু জন্মাবে এবং এক সময় শুকিয়ে ধুলা-বালির সাথে উড়ে মানুষের খাদ্যের সাথে দেহে প্রবেশ করবে। এসব থেকে বাঁচতে একটু ত্যাগ স্বীকার করে পশুর রক্ত ভালো করে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করে ফেলতে হবে।
আমরা দুর্গন্ধ এড়াতে এবং জীবাণু নাশ করতে ডিডিটি পাউডার ব্যবহার করি। কোরবানির সময় বর্জ্যরে ওপরে, কিংবা যেসব জায়গায় রক্ত পড়ে সেখানে ছিটিয়ে দিলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়। তবে ডিডিটি পাউডার ব্যবহারেও অত্যন্ত সচেতন থাকতে হবে। এটি মানুষের দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
কোরবানি পরবর্তী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট (এওট) ২০১৫ এর নভেম্বর থেকে এর বাস্তবায়নে কাজ করছে। সকল সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও জেলা সদরে প্রতি বছর জনস্বার্থে নির্ধারিত স্থানে কোরবানির পশু জবাই নিশ্চিত করতে বলা হয়। এবারও ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার মেয়র, বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসক বরাবর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।
পরিবেশ দূষণ রোধকল্পে ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় নির্ধারিত স্থানে কোরবানির পশু জবাই কার্যক্রমকে মূলত তিনটি পর্যায়ের অধীনে পরিকল্পনা করা হয়। এ তিনটি পর্যায় হচ্ছে (১) কোরবানির পশু সংখ্যার নিরিখে কোরবানির স্থান নির্ধারণ ও কোরবানি প্রদানের উপযোগীকরণ, জনমত গঠন ও প্রচার, বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহ প্রদান, সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ ও তার সংস্থান (২) সুষ্ঠুভাবে কোরবানি প্রদান নিশ্চিতকরণ এবং (৩) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
এ বছর দেশে কোরবানিযোগ্য মোট গবাদিপশুর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ যার মধ্যে গরু মহিষের সংখ্যা ৪৪ লাখ ৫৭ হাজার এবং ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা ৭১ লাখ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কোরবানির পশুর স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে দায়িত্ব পালন করছে। এ বছর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে ২১টি পশুর হাট বসবে যেখানে একটি ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম কাজ করবে। রাজধানীর হাটগুলিতে কর্তব্যরত প্রতিটি মেডিকেল টিমে ১ জন ভেটেরিনারি সার্জন, ১/২ জন টেকনিক্যাল কর্মচারী (ঠঋঅ/টখঅ) এবং শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টার্নশীপের ১ জন করে ভেটেরিনারি সার্জন থাকবেন।
ঈদ পরবর্তী সময় দেশের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সীমিত জনবল, অর্থ এবং যন্ত্রপাতি দিয়ে স্বল্প সময়ে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ করা কষ্টসাধ্য। ঈদ পরবর্তী দিনগুলোতে রাস্তায় আবর্জনা পচে অস্বাস্থ্যকর দূর্গন্ধ ছড়াতে পারে। ঈদ শুরুর কয়েক দিন আগে থেকেই লোকজন স্থানীয় হাট থেকে পশু কেনা শুরু করে। হাটগুলো যততত্র বসে এবং কোরবানিদাতা পশু কিনে অ্যাপার্টমেন্ট বা বাড়িতে রাখে যেখানে কয়েকদিন ধরে পশুগুলো রাখার উপযোগী তেমন ব্যবস্থা থাকে না। এসবও একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনা জরুরি। এবার কর্তৃপক্ষ হাট বসার স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে।
সরকার সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে পশু কোরবানি দেওয়ার জন্য স্থান নির্ধারণ করে দেওয়ার এবং বর্জ্য ফেলার জন্য ব্যাগ সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে বর্ণিত সুবিধাদি গ্রহণ করে নিজ নিজ এলাকাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশবান্ধব রাখা সম্ভব। সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত স্থানে পশু জবাই করা এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থাপনা কমিটির সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। শুধু সরকারি পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করলে চলবে না। এলাকাভিত্তিক ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত ছোটো-ছোটো পদক্ষেপ বৃহৎ আকারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
পশুর হাড়, লেজ, কান, মাথার খুলি ও পায়ের অবশিষ্টাংশ অবশ্যই এলাকার নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দিতে হবে। চেষ্টা করতে হবে কোনো মোটা প্লাস্টিকের ব্যাগে জড়িয়ে সেটি কাছাকাছি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দেওয়া। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ সেটি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সরিয়ে নেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
কর্তৃপক্ষ দ্রুততম সময়ে বর্জ্য অপসারণের কাজ শেষ করার বিষয়ে তৎপর রয়েছে। এ সময় নিয়মিত পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পাশাপাশি অতিরিক্ত পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। বিভিন্ন স্থানে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। ডাম্পার, পে লোডার, টায়ার ডোজার, পানির গাড়ি (জেট স্প্রেসহ), প্রাইম মুভার, ট্রেইলার,স্কেভেটর, চেইন ডোজার পরিচ্ছন্নতা কাজে গতি আনতে ব্যবহার করা হবে যা দ্রুত কোরবানি পরবর্তী বর্জ্য অপসারণে সহায়ক হবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন প্রচার করা যেতে পারে। তাছাড়া ঈদের কয়েকদিন আগে থেকে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে দৈনিক পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার স্ক্রলে উল্লিখিত বিষয়সম্বলিত তথ্য প্রচার করা যেতে পারে।
কোরবানিকৃত পশুর বর্জ্য নদর্মা/ জলাশয়ে না ফেলার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করতে হবে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রচারের পাশাপাশি স্টিকার, লিফলেট ও পোস্টার বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া মসজিদের ইমামগণ ঈদের আগের জুমআ ও ঈদের জামাতে মুসল্লিদের কোরবানির বর্জ্য অপসারণ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বড়ো ভূমিকা রাখতে পারেন। তাছাড়া বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিরূপণ করে কোরবানি পরবর্তী পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে লিফলেট, ফোল্ডার, পোস্টার ইত্যাদি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং সকল প্রিন্ট মিডিয়াতেও তা প্রচারের উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা প্রচার করেও সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। আসুন, এ বছর আমরা যারা কোরবানি আদায় করতে যাচ্ছি তারা সবাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখি। কোরবানির মাধ্যমে শুধু আত্মত্যাগ নয়, আত্মসচেতনতার শিক্ষাও নিতে হবে। কারণ পশু জবাইয়ের ফলে সৃষ্ট বর্জ্য যদি পরিবেশ দূষণ করে তবে তা ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণœ করে। প্রত্যেকের সচেতনতায় কোরবানিদাতার আত্মার শুদ্ধতার পাশাপাশি পরিবেশের শুদ্ধতাও নিশ্চিত হবে- এ প্রত্যাশা সকলের।