১৪ ফেব্রুয়ারীঃ স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস
- প্রকাশিত সময় ০৪:৫৪:৪৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২০
- / 134
সারা বিশ্বে ভ্যালেন্টাইন’স ডে বা ভালোবাসা দিবস হিসেবে পরিচিত হলেও, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৪ই ফেব্রুয়ারী বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। ১৯৮৩ সালের এই দিনে তৎকালীন সামিরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যা কালক্রমে গণ আন্দোলনে রূপ নেয়। অনেকে এই দিনটিকে তাই পালন করেন ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসাবে।
জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তখনকার শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান ১৯৮২ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রস্তাব করেন যেখানে প্রথম শ্রেণী থেকে আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মাপকাঠি করা হয় মেধা অথবা পঞ্চাশ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা।
এই নীতি ঘোষণার পর পরই ছাত্র সংগঠনগুলো তা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের ব্যাপারে একমত পোষন করে।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে স্মারকলিপি দিতে শিক্ষার্থীরা মিছিল করে সচিবালয়ের দিকে যাবার সময় পুলিশ গুলি চালায়। এতে জয়নাল ও দীপালি সাহা সহ নিহত হন অন্তত ১০জন।
সেদিনের সেই মিছিলে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়ের সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কর্মী তসলিমা রানা নীলা।
বর্তমানে লন্ডনের বাসিন্দা তসলিমা নীলা বলছিলেন, ৩৫ বছর আগের ঘটনা হলেও সেই দিনটি এখনো তার পরিষ্কার মনে আছে।
”তখন ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হিসাবে এখনকার মতো পালন করা হতো না। ১৯৮৩ সালের সেই দিনটি ছিল এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে একটি চরম মুহূর্ত।”
ছাত্রসমাজের দাবি ছিল একটি অবৈতনিক এবং বৈষম্যহীন শিক্ষানীতি। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান যে নীতি ঘোষণা করেন তাতে বাণিজ্যিকীকরণ আর ধর্মীয় চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন। তাই শুরু থেকেই ওই নীতির বিরোধিতা করতে থাকেন শিক্ষার্থীরা।
তসলিমা রানা নীলা আরো বলেন, ”সেদিন সকাল ১০টায় বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রদের জমায়েত হবার কথা। সেখান থেকে শিক্ষানীতি প্রত্যাহারের দাবিতে স্মারকলিপি নিয়ে শিক্ষা ভবনে যাওয়া হবে।”
”সকাল ১০টায় বটতলা থেকে মিছিল নিয়ে আমরা শিক্ষাভবনের দিকে যাচ্ছি। যখন আমরা কার্জন হল আর শিশু একাডেমীর মাঝখানের রাস্তাটায় এলাম, তখন আমরা প্রথম গুলির শব্দ শুনি। ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, সেখানে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। তখন রীতিমত গোলাগুলি হচ্ছে।”
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সে সময়ের কর্মী তসলিমা রানা নীলা বলছেন, ”আমরা দৌড়ে কার্জন হলে ঢুকে গেলাম। ওখানে বেশ কয়েক ঘণ্টা থাকলাম। তারপর বিকালের দিকে যখন অবস্থাটা একটু স্বাভাবিক হল, তখন আমরা আমার বটতলায় চলে এলাম।”
তিনি বলছেন, ”তখন শহরের অবস্থা ছিল খুবই থমথমে। আমরা বটতলায় জমায়েত হওয়ার পর জয়নালের মৃতদেহ ট্রাকে করে সেখানে আনা হলো। তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আখতারুজ্জামান বক্তৃতা দিচ্ছেন, এমন সময় আমরা হঠাৎ শুনতে পেলাম নতুন আনা রায়ট কারের শব্দ। সেটি রঙ্গিন পানি ছিটাচ্ছে, যাতে ছাত্রদের পরবর্তীতে সহজেই চিহ্নিত করা যায় আর গ্রেপ্তার করতে তাদের সুবিধা হয়।”
”আবার ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কলাভবনের পেছন দিক দিয়ে আরো অনেকের মতো আমিও দৌড়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় পেছনের ধাক্কায় আমি পড়ে যাই। আমার উপর দিয়ে অনেক ছাত্ররা চলে যায়, আমিও অনেক ব্যথা পাই। একটা সময় অর্ধ চেতন অবস্থায় আমি নিজেকে আবিষ্কার করি, আমাকে ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।” বলছেন তসলিমা রানা নীলা।
সাবেক ছাত্রনেতা ও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মোশতাক হোসেন একটি সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে বলেছেন, ”আমরা দেখেছি অনেক মৃতদেহ পুলিশ ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু জয়নাল নামের একজন ছাত্রকে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে সেই মৃতদেহ বটতলায় নিয়ে এসে আমরা বিক্ষোভ করি।”
তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, ”সেদিন পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫০জন নিহত হয়েছিল বলে আমরা ধারণা করি। কিন্তু দুজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাকি মৃতদেহগুলো গুম করে ফেলে। তাদের স্বজনরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে স্বজনদের কোন খোঁজ আর পাননি।”
তবে হতাহতের এই সংখ্যার বিষয়ে তখন সরকারিভাবে কোন বক্তব্য দেয়া হয়নি।
”সেদিন থেকে এই দিনটিকে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসাবে বলা হয়”, বলছেন মোশতাক হোসেন।
বিকালে এবং পরের দিনও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চলে বলে তিনি জানান। অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা হয়। মোশতাক হোসেনকেও গ্রেপ্তার করা হয় সেসময়।
তিনি জানান, জয়নাল ছাড়াও পরে মোজাম্মেল আইয়ুব নামের আরেকজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। জাফর, কাঞ্চন, দীপালি সাহা নামের একটি ছোট বাচ্চাসহ অনেকে নিখোঁজ হয়ে যায়, যাদের পরে আর কোন খোঁজ মেলেনি।
এর কিছুদিন পরে সরকার একটি ঘোষণা দিয়ে শিক্ষানীতিটি স্থগিত করে।
সূত্রঃ বিবিসি